সোমবার, ১১ মার্চ ২০১৩, ২৭ ফাল্গুন ১৪১৯
নোয়াখালীর সন্ত্রাস কবলিত গ্রাম থেকে ফিরে
মহিউদ্দিন আহমেদ, নোয়াখালী রাজাগঞ্জ থেকে ফিরে ॥ নোয়াখালী রাজাগঞ্জ এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির ও বাড়ি ঘরে তাণ্ডবলীলা ছিল পরিকল্পিত। ঘটনার আগে দু’দিনব্যাপী ওই এলাকায় জামায়াত সাঈদীর সাফাই ওয়াজের আয়োজন করে। ওয়াজে বক্তারা সাঈদীর জন্য রক্ত ও জীবন দিতে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান স্থানীয়দের। জামায়াতের তথাকথিত আলেমদের উস্কানিতে হিন্দুদের সাক্ষ্যে জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসি হয়েছে গুজব ছড়িয়ে আলাদি নগর গ্রামে হামলা করে স্থানীয় জামায়াত-শিবির। হামলাকারীরা গানপাউডারসহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তিনভাগে বিভক্ত হয়ে সন্ত্রাস তাণ্ডব চালায়। রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে একটি গ্রুপ ঘরে ঘরে অগ্নিসংযোগ করে, আরেকটি গ্রুপ লুটপাট, তৃতীয় গ্রুপের দায়িত্ব ছিল নির্যাতন। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে ২৮ ফেব্রুয়ারি নির্মম ঘটনার নেপথ্যের এসব ঘটনা জানা গেছে।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধীতাকারী, মানবতাবিরোধী অপরাধের অপরাধী, জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীরসহ চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ বানচাল করতে নানা ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত অব্যাহত রেখেছে যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত-শিবির। নোয়াখালীর রাজাগঞ্জের আলাদী নগর গ্রামের হিন্দু সংখ্যালঘুদের বাড়িতে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, মন্দির ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনাটি তারই ধারাবাহিক একটি ঘটনা বলে জানান স্থানীয়রা। তারা জানান, নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানাধীন রাজাগঞ্জ আলাদী নগর গ্রামটি শহর থেকে দূরে। ওই এলাকায় হিন্দু পাড়াটিতে শহর থেকে পৌছতে প্রায় একঘণ্টা সময় লাগে। তাই উগ্র, ধর্মান্ধ তথাকথিত ইসলামী দল জামায়াত এই এলাকাটির সংখ্যালঘুদের বাড়িতে হামলার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বাড়তি শক্তি হিসেবে সঙ্গে পায় স্থানীয় কিছু বিএনপির নেতাকর্মী। লক্ষ্য বাস্তবায়নে জামায়াত-বিএএনপির নেতাকর্মীদের সংঘবদ্ধ করতে ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি, দু’দিনব্যাপী ওয়াজের আয়োজন করে ইসলামী পাঠাগার ও সমাজকল্যাণ পরিষদ। এই দুটি সংগঠন জামায়াত নিয়ন্ত্রিত এবং জামায়াত নেতারা পরিচালনা করেন। রাজাগঞ্জ হাইস্কুল ময়দানে অনুষ্ঠিত ওয়াজে দলীয় স্বার্থসিদ্ধি ও সাঈদীর সাফাই সংক্রান্ত তাফসির করেন নির্ধারিত তথাকথিত আলেমরা। তাদের মধ্যে ছিলেন, মাওলানা কাজী মোহাম্মদ ইব্রাহীম। তিনি ঢাকা থাকেন। কুমিল্লার চান্দিনা আলিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল আনম মাইন উদ্দিন সিরাজী, বাংলাদেশ ইসলামীক ইউনিভার্সিটির শিক্ষক অধ্যাপক ড. মতিউল ইসলাম। তাদের কেউ কেউ তিনটি বেসরকারী টেলিভিশনে ইসলামী অনুষ্ঠানে ধর্মীয় আলোচনা করেন। ওয়াজের প্রথমদিন ধর্মীয় বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে আলোচনা করলেও শেষদিন তারা মতলববাজি রাস্তা ধরেন বলে জানান, স্থানীয়রা। তারা জানান, শেষদিন ওয়াজের শেষদিকে ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষকে উদ্দেশ্য করে অনেক উস্কানিমূলক আলোচনা করা হয়। জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে প্রকৃত আলেম, আন্তর্জাতিকমানের আলেম- ইসলামী চিন্তাবিদসহ বিভিন্ন বিশ্লেষণে বিশেষায়িত করেন কেউ কেউ। একই সঙ্গে সাঈদীর ফাঁসির রায় দিলে তার জন্য রক্ত ও জীবন দিতে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান এসব তথাকথিত আলেমরা। ২৮ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ সাঈদীর যুদ্ধাপরাধ মামলার রায় দেয়ার পর স্থানীয় জামায়াত-শিবিরি গুজব ছড়িয়ে দেয় হিন্দুদের সাক্ষীর কারণে সাঈদীর ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছে। এ গুজব ছড়িয়ে হিন্দুদের রক্ষা নাই স্লোগান দিতে থাকে। এ গুজবটি ছড়িয়ে তারা নিজেরা সংগঠিত হয়। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় স্থানীয় বিএনপি কিছু-নেতাকর্মী। এমন গুজব আর গত দুইদিন ওয়াজের কারণে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ নীরব হয়ে যায়। এই সুযোগ নিয়ে রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে আলাদি গ্রামের হিন্দু বাড়িতে হামলা চালায় তারা। হামলার সময় জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীরা, তিনভাগে কাজ করে। একটি গ্রুপ ছিল অগ্নিসংযোগের দায়িত্বে। অগ্নিসংযোগের আগে তারা গানপাওডার ছিটিয়ে দেয়। এর আগে একটি গ্রুপ ঘরের টিনে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। পরিস্থিতি দেখে ঘর থেকে বের হয়ে প্রাণ ভয়ে যখন পালাতে থাকে তখন একটি গ্রুপ লুটপাটের কাজটি শুরু করে। বিমল কান্তি ঠাকুর বাড়ির একটি ঘর থেকে তিন ভরি স্বর্ণ এবং নগদ চার লাখ টাকা নিয়ে যায়। আরও তিন লাখ ৩৩ হাজার টাকা পোড়া যায় ঘরের মালিকের। এ ছাড়া গঙ্গাপ্রসাদ ভুইয়া বাড়ির শ্যামলী চৌধুরীর ঘর থেকে নগদ ৫০ হাজার এবং সাড়ে তিন ভরি স্বর্ণ এবং রূপা নিয়ে যায় হামলাকারীরা। এ দুই ঘরের মতো আলাদী গ্রামের যতটি বাড়িতে ২৮ ফেব্রুয়ারি আগুন দেয় জামায়াত-শিবির কর্মীরা সবগুলো ঘর থেকে স্বর্ণালংকার ও নগদ টাকা লুট করে নেয়। শনিবার নির্যাতিতদের সঙ্গে কথা বলে এসব খবর জানা যায়। তারা বলেন, হামলায় স্থানীয় বিএনপি-জামায়াত নেতাদের পাশাপাশি অনেকগুলো অপরিচিত মুখ তারা দেখছেন। তবে সবাই পাঞ্জাবী, পায়জামা পরা। অপরিচিতদের বেশিরভাগের বয়স ২২ বছরের নীচে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, তাণ্ডব পূর্বকল্পিত হওয়ার কারণে স্থানীয়রা এলাকার বাইরের মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের আগ থেকে নিয়ে এসেছে। তাছাড়া গানপাউডার, অস্ত্র, বড় বড় লাঠিসোটা ব্যবহার করা হয়। হামলার আগে আলাদী গ্রামে প্রবেশ পথের সড়কগুলোতে গাছের গুঁড়ি ফেলে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়। যেন আইন-শৃখলা বাহিনী প্রবেশ করতে না পারে। যার কারণে যতগুলো বাড়িতে আগুন দেয়া হয়েছে সবগুলো ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তাছাড়া ওই এলাকার ৭টি মন্দির ভাংচুর করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হামলার সময় হিন্দুদের সাক্ষীতে সাঈদীর ফাঁসির রায় হয়েছে গুজব এবং গত দু’দিনের ওয়াজে সাঈদীর সাফাইর কারণে সাধারণ মানুষ হিন্দুদের পক্ষে অবস্থান নেয়া থেকে বিরত ছিল। তাছাড়া প্রতিবেশী যেসব মুসলিম হিন্দুদের সহায়তায় এগিয়ে আসার আগ্রহ দেখিয়েছে তাদের ওপর চড়াও হয় হামলাকারী জামায়াত-শিবির। ওই সময় তারা স্লোগান দেয়, ‘সাঈদীর বাংলায়, হিন্দুদের ঠাই নাই’ হিন্দুদের রক্ষা নেই। ‘সাঈদীর ফাঁসি হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে। এই রকম আরও অনেক স্লোগান দেয়া হয়। এছাড়া ঘরে ও মন্দিরে আগুন দেয়ার আগে আল্লাহু আকবার বলে একসঙ্গে স্লোগান দেয় জামায়াত-শিবির কর্মীরা।
দৈনিক জনকণ্ঠ। লিংক
No comments:
Post a Comment