মহাজোটের সামনে নতুন সুযোগ

রোবায়েত ফেরদৌস, দীপায়ন খীসা, দেবাশীষ কাঁকন, বিমান চন্দ্র বড়ূয়া, লিপিকা ত্রিপুরা, শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন, শিরিন সুলতানা লিরা, অঞ্জন রায়, সৌরভ সিকদার ও সৌমিত্র শেখর

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটের অভূতপূর্ব বিজয় নিয়ে নানামুখী বিশ্লেষণ হচ্ছে। অতি সম্প্রতি গণতান্ত্রিক বিশ্বের পার্লামেন্ট নির্বাচনে এ জাতীয় অভাবনীয় ও নিরঙ্কুশ বিজয়ের উদাহরণ নেই। বাংলাদেশের ইতিহাসেও এ নির্বাচন ও বিজয় বিশেষ গুরুত্ববহ। নির্বাচনের অব্যবহিত আগে রাজনৈতিক দলগুলো ‘নির্বাচনী ইশতেহার’ যখন প্রকাশ করে, সে সময় মানুষের মধ্যে যে আগ্রহ লক্ষ্য করা গেছে তাতে এ কথা স্পষ্ট করে বলা যায়, জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি। তবে তাদের প্রত্যাশা মূলত দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ঘিরেই। তাই সাম্প্রতিক নির্বাচনে মহাজোট নিরঙ্কুশভাবে বিজয়ী হলেও মানুষের আশা মূলত এর প্রধান দলকে কেন্দ্র করেই। রাজনৈতিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি গণমুখী ও অসাম্প্রদায়িক। ইশতেহারে দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বেকারত্ব, যুদ্ধাপরাধ ইত্যাদির বিরুদ্ধে দলটির সরাসরি অবস্থান স্পষ্ট। আশা করা যায়, এ প্রশ্নে মহাজোটের প্রতিটি দলের অবস্থান সমমেরুতেই হবে। জোটের দলগুলো নতুন প্রজন্মের ভোটারদের প্রতি যেমন প্রতিশ্রুতিশীল ছিল, তেমনি নারী ভোটার এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রশ্নেও উদার এবং সমদৃষ্টির পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছে।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেখা গেছে, উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বয়সে তরুণ ও নারী প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন মহাজোট থেকে। দেশের ভোটাররা এবার নির্বাচনে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশিসংখ্যক নারীপ্রার্থীকে সরাসরি ভোটে বিজয়ীও করেছেন। শুধু তা-ই নয়, মহাজোট থেকে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী; বাঙালি ও আদিবাসী প্রার্থীদের সংসদ সদস্যপদে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। এই দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই প্রশংসার যোগ্য। এই পদক্ষেপ জনতা কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছে বলা যায়। কারণ জনগণ সংসদ নির্বাচনে ধর্ম বা জাতিগত সাম্প্রদায়িক অবস্থাকে বিবেচনায় না এনে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে তাদের বিচারে সৎ ও যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচিত করেছেন।

পার্বত্য জেলাগুলোতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আদিবাসী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু ভোটার আছে, এ কারণটি ওই অঞ্চলে আদিবাসী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু প্রার্থী বিজয়ী হওয়ার মূলে নয়। যদি তাই হতো তাহলে ময়মনসিংহ-১ আসনে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী আদিবাসী প্রার্থী তার নিকটতম বাঙালি মুসলিম প্রার্থীর চেয়ে বায়ান্নহাজার বেশি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হওয়ার কথা নয়। কেননা, এই আসনে আদিবাসী ভোটারের সংখ্যা চৌদ্দ-পনের হাজারের মতো। আসলে এ দেশের সাধারণ মানুষ জাত-ধর্ম নির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িক চেতনা লালন করে সৎ ও যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনের লক্ষ্যে ভোট দিয়েছে।

আমাদের সংবিধানেও জনগণের এই চেতনার প্রকাশ ঘটেছে। সংবিধানের ২৯(২) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে লেখা আছে : ‘কেবল, ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিক প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদলাভের অযোগ্য হইবেন না কিংবা সেই ক্ষেত্রে তাহার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করা যাইবে না।’ সরাসরি ভোট প্রদান করে জনতার রায় দান এবং সংবিধানের পাতায় লিপিবদ্ধ থাকার পরও এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের বাস্তবচিত্র ভিন্ন। দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় চার দশক পরও বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোয়, সশস্ত্র বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে বা দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন দাফতরিক প্রধান হিসেবে যাদের দেখা গেছে বা যাচ্ছে তাতে জাত-ধর্মের প্রশ্নটি বিবেচনার ঊর্ধ্বে ছিল বা আছে তা বলা যায় না। অথচ জাত-ধর্মের এই ‘বিবেচনা’ আমাদের সংবিধানবিরোধী এবং জনতার অসাম্প্রদায়িক চেতনা পরিপন্থীও বটে।

নতুন শতকে বিশ্ব আজ নতুনভাবে বিকশিত হচ্ছে। আমেরিকার সাম্প্রতিক নির্বাচনে কৃষ্ণাঙ্গ এবং মুসলিম পিতার সন্তান বারাক ওবামা বিপুল ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। পাকিস্তানের মতো দেশেও প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন রানা ভগবানদাস- ধর্মীয় পরিচয়ে যিনি হিন্দু। ভারতের ষাট বছরের ইতিহাসে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদ থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে ধর্ম ও জাতি নির্বিশেষে সংখ্যালঘুদের ব্যাপক নিয়োগ ওই রাষ্ট্রকে অভ্যন্তরীণভাবে দৃঢ় এবং বহির্বিশ্বে তার ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর করেছে। জাকির হোসেন, ফখরুদ্দীন, জৈল সিং, এ পি জে আবদুল কালাম প্রমুখ ভারতের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বর্তমানে আছেন শিখ ধর্মাবলম্বী মনমোহন সিং, বর্তমান উপ-রাষ্ট্রপতি একজন মুসলিম (হামিদ আনসারী)। তাছাড়া ভারতে ইতিপূর্বে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদও মুসলিম ধর্মাবলম্বী অলঙ্কৃত করেছেন।

বিশ্বের এসব উদাহরণ, দেশের ভোটারদের অসাম্প্রদায়িক রায় ও সংবিধানের ২৯(২) অনুচ্ছেদের চেতনার সমন্বয় ঘটিয়ে বাংলাদেশে একজন ধর্মীয় বা জাতিগত সংখ্যালঘু রাষ্ট্রপতি কিংবা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে মনোনয়ন প্রদান আজ সময়ের দাবি। মহাজোট নেত্রী ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছেন, বিরোধী দল থেকে তিনি সংসদীয় কমিটিগুলোতে অংশগ্রহণ বাড়াবেন, বিরোধী দলকে ডেপুটি স্পিকারের পদ দেবেন। তার এই ঘোষণা বিভিন্ন মহলে অভিনন্দিত হয়েছে। ১৯৯৬ সালে বিজয়ী হয়েও শেখ হাসিনা ‘ঐকমত্যের সরকারের’ ধারণা প্রদান করেছিলেন এবং বিরোধী দল থেকে আনোয়ার হোসেন ও আ স ম আবদুর রবকে মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে দলনিরপেক্ষ রাষ্ট্রপতিও নির্বাচন করেছিলেন। এবার আওয়ামী লীগ ও মহাজোটের সংসদীয় অবস্থা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো। বিশ্বব্যবস্থাও অনুকূলে। নতুন শতকে যে ‘দিনবদলের সনদ’ ঘোষিত হয়েছে, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ধর্মীয় বা জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে মনোনয়নের বিষয়টি বিবেচনা করে আওয়ামী লীগ এবং মহাজোট বাংলাদেশে আর একটি ইতিহাস সৃষ্টি করতেই পারে।

সমকাল, ৭ জানুয়ারি, ২০০৯

No comments:

Post a Comment