৩২ জেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতা, ২৪ দিনে ৩১৯টি মন্দির, দেড় হাজার বাড়ি-দোকানে হামলা |
২৮ ফেব্রুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার রায়ে জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পর থেকে এসব হামলা চালানো হয়। জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা ফাঁসির আদেশে ক্ষুব্ধ হয়ে হামলা চালান বলে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি, প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানিয়েছে। কিছু এলাকায় বিএনপির কর্মী-সমর্থকেরাও হামলায় জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে শুরু থেকেই জামায়াত এ ধরনের হামলায় জড়িত, থাকার কথা অস্বীকার করে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে আসছে।
অবশ্য এক সপ্তাহ ধরে গভীর রাতে বিভিন্ন স্থানে মন্দিরে হামলা চালানো হচ্ছে। এসব হামলায় কারা জড়িত পুলিশ ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা তা বলতে পারছে না।
২৪ দিনের ঘটনায় সংখ্যালঘু ব্যক্তিরা ২৬টি মামলা করেছেন। পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে ১৭টি। এসব মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছে ১৮৯ জন।
চট্টগ্রাম: রায় ঘোষণার দিন জামায়াত-শিবির বাঁশখালী উপজেলার জলদী ও গুনাগরি এলাকায় সাতটি বাড়ি, তিনটি মন্দির ও ৪০টি দোকানে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে। জলদীর ধোপাপাড়া এলাকায় কুপিয়ে হত্যা করা হয় বৃদ্ধ দয়াল হরিকে। এতে আহত হয় অন্তত ১৫ জন।
একই দিন সাতকানিয়া উপজেলার চরতি ইউনিয়নে নয়টি মন্দির, নয়টি দোকানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে ৫৮ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে প্রশাসন জানিয়েছে।
৮ মার্চ রাতে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার পদুয়ার আঁধারমানিক শীলপাড়ার তিনজনের বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। বাড়ির লোকজন কোনোরকমে বাঁচতে পারলেও পুড়ে ছাই হয়ে যায় বসতভিটা। চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ১৩টি দোকানে আগুন দেওয়া হয়।
নোয়াখালী: ২৮ ফেব্রুয়ারি বেলা পৌনে দুইটা থেকে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত বেগমগঞ্জ উপজেলার রাজগঞ্জ বাজার এবং পাশের আলাদীনগর ও টঙ্গীরপার গ্রামে ব্যাপক তাণ্ডব চালানো হয়। আগুনে আটটি বাড়ির ২১টি ঘর সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয় ৪৬টি ঘরে।
ছয়টি মন্দির ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ভেঙে ফেলা হয় মন্দিরের প্রতিমাগুলো। হামলা চালানো হয় রাজগঞ্জ বাজারের হিন্দুদের সাতটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে। পরে আগুন দেওয়া হয় চাটখিল উপজেলায় একটি মন্দিরসহ সেনবাগ ও কবিরহাট উপজেলার সাতটি বাড়ির ১০টি খড়ের গাদায়।
এর মধ্যে আলাদীনগর গ্রামের মালীবাড়িতেই পুড়িয়ে দেওয়া হয় ১২টি বসতঘর। বাড়ির বাসিন্দা অমূল্য চন্দ্র জানান, পরনের কাপড় ছাড়া কিছুই রক্ষা করতে পারেননি তাঁদের বাড়ির লোকজন।
এসব ঘটনায় বেগমগঞ্জ থানার পুলিশ বাদী হয়ে একটি মামলা করে। এতে জামায়াত-শিবির ও বিএনপির ৭১ জনের নাম উল্লেখ করে দেড় থেকে দুই হাজার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। পুলিশ গ্রেপ্তার করে ৩৮ জনকে।
সর্বশেষ শুক্রবার রাতে বেগমগঞ্জের রাজগঞ্জের কালিরহাট রক্ষাকালী মন্দিরে আবারও হামলা চালিয়ে মন্দিরের সীমানা প্রাচীর ভাঙচুর করা হয়। একই রাতে চৌমুহনী চৌরাস্তায় আরেকটি রক্ষাকালী মন্দিরে হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা।
রংপুর: ২৮ ফেব্রুয়ারি মিঠাপুকুর উপজেলার পাঁচটি মন্দির ও ৮ মার্চ নগরের আমাশু কুকরুল এলাকায় একটি মন্দির ও মন্দিরভিত্তিক পাঠাগার পুড়িয়ে দেয় জামায়াত-শিবির। পীরগাছার তাম্বুলপুর বাজারে হিন্দুদের পাঁচটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। পুলিশ তিনটি মামলা করলেও কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
দিনাজপুর: ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ২ মার্চ জেলার খানসামা, চিরিরবন্দর ও সদর উপজেলায় সংখ্যালঘুদের ১৪টি বাড়ি, সাতটি দোকান ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এসব ঘটনায় সাতটি মামলা করেছে তিন থানার পুলিশ।
বগুড়া: ৩ থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত জেলার গাবতলী ও দুপচাঁচিয়া উপজেলার পাঁচটি মন্দিরে হামলা, প্রতিমা ভাঙচুর এবং একটি মন্দিরে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। হিন্দুদের দুজনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও হামলা হয়েছে। শেরপুর উপজেলায় দুই ব্যক্তির খড়ের গাদায় অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা।
জয়পুরহাট: পাঁচবিবি ও সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে হিন্দুদের ২৪টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও আটটি বাড়ি ভাঙচুর, লুটপাট এবং সেগুলোতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। জামায়াত-শিবিরের নেতৃত্বে এ হামলায় একটি মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়। রায় ঘোষণার পরপর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়। জেলার তিনটি থানায় পুলিশ ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা বাদী হয়ে ৫২টি মামলা করেছেন। পাঁচবিবি থানায় ৪১টি, সদর থানায় সাতটি ও কালাই থানায় চারটি মামলায় ৪০০ জনের নামে এবং অজ্ঞাত পরিচয় আরও ১৫ থেকে ১৬ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে।
জয়পুরহাট জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্যপরিষদের সভাপতি নৃপেন্দ্রনাথ মণ্ডল বলেন, জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডবে জেলার সংখ্যালঘু ব্যক্তিদের প্রায় দেড় থেকে দুই কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
খুলনা: বিএনপির ডাকা হরতাল চলাকালে ৫ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মিছিল নিয়ে খুলনার কয়রা উপজেলার আমাদী বাজারের হামলা করে ২০টির বেশি দোকান ভাঙচুর করা হয়। এলাকাবাসী ও ব্যবসায়ীরা প্রতিরোধ করলে হামলাকারীরা বাজারের পাশে রজকপাড়ায় (ধোপা) ঢুকে বাড়িঘর ভাঙচুর ও লুটপাট শুরু করে। একপর্যায়ে হামলাকারীরা নারীদের আটকে রেখে কয়েকটি বাড়ি ও একটি মন্দিরে আগুন ধরিয়ে দেয়।
১৮ মার্চ রাত সাড়ে আটটার দিকে একদল দুর্বৃত্ত ককটেল ফাটিয়ে ও লাঠি, রামদা, ইট নিয়ে খুলনা নগরের দৌলতপুর পাবলা বণিকপাড়ার দুটি হিন্দু মন্দির এবং তাদের অর্ধশতাধিক বাড়িঘরে হামলা ও ভাঙচুর চালায়।
পাবলা বণিকপাড়া সর্বজনীন কালীমন্দিরের সাধারণ সম্পাদক তিলক গোস্বামী বলেন, ‘দেশ স্বাধীনের পর আগে কখনো এমন ঘটনা দেখিনি।’ এ ঘটনায় দুটি মামলায় ২৮ জন গ্রেপ্তার হয়েছে।
সাতক্ষীরা: জেলা সদর, শ্যামনগর ও দেবহাটা উপজেলায় ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯ মার্চ পর্যন্ত হিন্দুদের ১৩টি দোকান, একটি বাড়িতে ভাঙচুর, অগ্নিংযোগ ও লুটপাট করা হয়।
গত বুধবার সদর উপজেলার শাখরা বাজারে গেলে একজন গ্রাম্যচিকিৎসক বলেন, ৪ মার্চ রাত সাড়ে সাতটার দিকে জামায়াত-শিবিরের কর্মী-সমর্থক তাঁর ক্লিনিকসহ বাজারের কয়েকজন হিন্দু ব্যবসায়ীর প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর ও লুটপাট করে।
ওই বাজারের একটি দোকানের মালিক জানান, ৪ মার্চ ভোমরার দিক থেকে আসা জামায়াত-শিবিরের কয়েক শ নেতা-কর্মীর মিছিল থেকে তাঁর দোকানের শোকেস ও ফ্রিজ ভাঙচুর করে টাকা, মিষ্টি ও দই লুটপাট করা হয়।
শ্যামনগরের নওয়াবেকি বাজারের একজন ব্যবসায়ী তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বসতবাড়ি ও মন্দিরে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের কথা বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি আক্ষেপের সঙ্গে বলেন, লুটপাট করলে কিছু থাকে। কিন্তু পুড়িয়ে দিলে সব শেষ হয়ে যায়। সেই ছাই দিয়েও কোনো কাজ করা যায় না।
সাতক্ষীরা জেলা পূজা উদ্যাপন কমিটির সভাপতি মনোরঞ্জন মুখার্জি বলেন, দেশে কিছু ঘটলেই সংখ্যালঘু ব্যক্তিরা তার বলি হচ্ছে। প্রশাসনের কাছে বারবার সহযোগিতা চেয়েও পাওয়া যায়নি। হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের পর সংখ্যালঘু ব্যক্তিরা মামলা করারও সাহস পাচ্ছেন না।
পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও হত্যার অভিযোগে ৬৫টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় এক হাজার ৯৬ জনের নাম উল্লেখ করে কয়েক হাজার মানুষকে আসামি করা হয়েছে। বুধবার ৯০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ: ২৮ ফেব্রুয়ারি কানসাট পল্লী বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে অগ্নিসংযোগের পর কানসাট গঙ্গা আশ্রম, গঙ্গামন্দির ও কালীমন্দিরেও হামলা চালানো হয়। দুর্বৃত্তরা আশ্রমঘাটের ১৩০ ফুট পাকা সীমানাপ্রাচীরসহ দুটি গেট, গঙ্গামন্দিরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ এবং কালীমন্দিরের প্রাচীর ভেঙে ফেলে।
৩ মার্চ রাতে দুর্বৃত্তরা শিবগঞ্জ পৌর এলাকার আলীডাঙ্গা গ্রামের দুর্গামন্দিরের বাঁশ-কাঠ-খড়ের দুর্গা প্রতিমার কাঠামো পুড়িয়ে দেয়। মন্দির থেকে সরস্বতী দেবীর একটি প্রতিমাও চুরি করে নিয়ে যায়।
সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর ও বেলকুচি উপজেলায় পাঁচটি; কক্সবাজারের কুতুবদিয়া, গাজীপুরের সদর ও শ্রীপুরে তিনটি করে; পটুয়াখালীর বাউফল, লালমনিরহাটের আদিতমারী ও হাতীবান্ধা, লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও রায়পুর, নেত্রকোনার সদর ও পূর্বধলা, কুমিল্লার দাউদকান্দি ও ব্রাহ্মণপাড়া এবং মুন্সিগঞ্জের লৌহজং ও সিরাজদিখান উপজেলায় দুটি করে মন্দির ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুর এবং অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে বরগুনার বামনা, ময়মনসিংহের ফুলবাড়ী, গোপালগঞ্জ, পাবনা, বরিশালের গৌরনদী, মৌলভীবাজারের বড়লেখা, নাটোর, শেরপুর ও নীলফামারীতে। লক্ষ্মীপুর, ফেনী, নাটোর ও গাইবান্ধায় একটি করে বাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় চারটি দোকান ও মৌলভীবাজারের বড়লেখায় তিনটি দোকান এবং সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার এক সংখ্যালঘু ব্যক্তির দেবতাঘরে আগুন দেওয়া হয়।
গত শুক্রবার রাতে মাদারীপুর শহরের কুলপদ্বী এলাকায় মৎস্যজীবী উত্তম কুমার মালোর বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে দুর্বত্তরা।
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রতিনিধি ও সংবাদদাতারা]
প্রথম আলো
ধন্যবাদ দাদা........তবে ইসলামের লেবাসে কিছু লেবাসীদরে কয়েকটি লিংক দেওয়ার অনুরোধ রইলো এখানে। আপনাদের হিন্দু পেজ দিলে তারা মাইন্ড করতে পারে। আমার কাছে সাইফ এসলাম আইডিতে ইনবক্সে দিয়েন। ওদেরকে দেখাতে পারবো।https://www.facebook.com/permalink.php?story_fbid=1766748336904965&id=100007094463049&comment_id=1766749556904843¬if_t=feed_comment_reply¬if_id=1467043507804355
ReplyDelete