মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ (৪)
তপন বিশ্বাস ॥ ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দেশজুড়ে শুরু হয় প্রতিহিংসার রাজনীতি। আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়ার অপরাধের দায় মেটাতে হয়েছে অসংখ্য সংখ্যালঘু নারীকে ইজ্জত দিয়ে। এ আঘাত সইতে না পেরে কেউ অপ্রকৃতস্থ হয়েছে সারা জীবনের জন্য। কেউ অাত্মহনন করেছে। কেউ কেউ মুখ বুজে সহ্য করলেও তাদের দীর্ঘ নিশ্বাসে আজও স্মরণ করে ২০০১-এর সেই নির্বাচনকে। এই নারকীয় ঘটনায় অনেকে হাত-পা হারিয়ে চিরতরে পঙ্গু হয়েছে। এ জাতীয় আরও কিছু ঘটনা থাকছে ধারাবাহিকের এই পর্বে।২০০১ সালের নির্বাচনের পর মুহূর্তেই খুন, লণ্ঠন, অগ্নি সংযোগ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি ধর্ষণ শুরু করে বিএনপি-জামায়াত জোটের নরপিশাচরা। আবাল-বৃদ্ধা-বনিতা, প্রতিবন্ধী কেউ এদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। হায়নারা যেন দল বেঁধে নামে ধর্ষণে। ৯ বছরের শিশু কাজলীও ধর্ষণের শিকার হয়েছে এই নরপশুদের হাতে। মদ খেয়ে ধর্ষণে মাতোয়ার হয়ে ওঠে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা। এ সময়ে ঘটনা শুধু মধ্যযুগীয় নয়, যে কোন সময়ের বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে।
গোটা বাঙালী জাতি এ নারকীয় ঘটনার ধিক্কার জানিয়েছিল, জানিয়ে যাচ্ছেও। জাতি চায় মানুষরূপী এই নরপশুদের দৃষ্টানত্মমূলক বিচার হোক। রাজনীতি করা বা বিশেষ কোন দলকে সমর্থন করা মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। মানুষের গণতান্ত্রিক এই অধিকারকে নস্যাত করতে নারকীয় এই ঘটনা করে উলস্নাস করে এরা । গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনা বর্তমানে দেশের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর কাছে বাংলার মানুষের অনেক প্রত্যাশা। ভিন্ন মত থাকবে। কিন্তু দেশের অধিকাংশ মানুষ তাঁকে পছন্দ করে, তাঁকে চায় বলেই তো ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে আওয়ামী লীগ এবার ৰমতায় এসেছে। জাতির আকাঙ্ৰা গণতন্ত্রের মানসকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবতাবিরোধী এই অপরাধীদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন। এদের দৃষ্টানত্মমূলক শাস্তি দেবেন, যাতে ভবিষ্যতে আর কেউ এ জাতীয় ঘৃণ্য অপরাধ করতে সাহস না পায়।
নির্বাচনের দিন রাতে অর্থাৎ ২০০১ সালের ১ অক্টোবর বরিশালের গৌরনদীর চানসি গ্রামে সাবিত্রী দাস গণধর্ষণের শিকার হয়। মধ্যরাতে ১০/১২ সন্ত্রাসী সাবিত্রী রানী দাসের ঘরে দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ে। এ সময় তার স্বামী বাধা দিলে তাকে মারধর করে ঘরে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখে। স্বামী চোখের সামনে স্ত্রী সাবিত্রীকে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে একে একে ধর্ষণ শুরু করে। পালাক্রমে রাতভর চলে এই ধর্ষণ প্রক্রিয়া। ভোরে সন্ত্রাসীরা তাদের ফেলে চলে যায়। এ ঘটনায় সাবিত্রী রানী মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। ঘটনার ১০ বছর পর তদন্ত কমিশন গিয়ে তাকে অপ্রকৃতস্থ দেখতে পায়।
নির্বাচনের পরদিন অর্থাৎ ২০০১ সালের ২ অক্টোবর রাতে যুবদল ও ছাত্রদলের সন্ত্রাসীদের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে ফরিদপুরে ডিগ্রী পড়ুয়া এক সংখ্যালঘু মেয়ের প্রতি। সবেমাত্র এইচএসসি পাস করে ডিগ্রীতে ভর্তি হওয়া সংখ্যালঘু পরিবারের এই মেয়েটির প্রতি তাদের লোলুপ দৃষ্টি আগে থেকেই ছিল। নির্বাচনের পর দেশজুড়ে খুন, ধর্ষণ, লুটপাট শুরু হলে রাতের অাঁধারে তারাও বাসনা মেটাতে ছুটে আসে মেয়েটির বাড়িতে। মেয়েটিকে তার বাড়িতে ফেলে মা-বাবার চোখের সামনে গণধর্ষণ করে নরপিশাচরা। ১০ বছর পর তদন্ত কমিশন ফরিদপুরে তাদের বাড়ি গেলে মেয়েটির মা-বাবা কমিশনের সদস্যদের পা জড়িয়ে ধরে। এ সময় কমিশনকে তারা জানায় ঘটনাটি তারা ভুলে যেতে চায়। মেয়েটিকে বিয়ে দেয়া হয়েছে। কোন কারণে এ ঘটনা যাতে প্রকাশ না পায় তারা সে অনুরোধ জানায়।
নাবালিকা কাজলী ধর্ষণ ॥ ২০০২ সালে ২১ মার্চ রাতে রাজশাহীর বাগমারা থানার কোন্দা গ্রামে মোঃ রজব আলী রাতের খাওয়া শেষে তার স্ত্রী অলকজান একটি ঘরে এবং তার ছেলে জুয়েল ও মেয়ে রজুফা ওরফে কাজলী (৯) অপর একটি ঘরে ঘুমিয়ে পড়ে। রাত আনুমানিক ৩টার দিকে বিএনপি সমর্থিত ১. আশরাফুল আলম, ২. ইসরাফিল, ৩. রহিম উদ্দিন, ৪ মকলেছুর (মকে), ৫ জাকিরম্নল ওরফে সান্টু, ৬. আসকান ওরফে আমিনুল ও আমজাদ হোসেন সর্ব সাং কোন্দা, বাগমারা তালা ভেঙ্গে ঘরে প্রবেশ করে নাবালিকা মেয়ে কাজলীকে ধর্ষণ করার চেষ্টা করে। এ সময় বাধা দিতে এতে কাজলীর ভাইয়ের গলায় এক সন্ত্রাসী চাকু ধরে। অপর এক সন্ত্রাসী চাকু দিয়ে কাজলীর যৌনাঙ্গের কাছে পাজামা কেটে তাকে ধর্ষণ করে। পাজামা কাটার সময় চাকুর আঘাতে কাজলীর যৌনাঙ্গের অংশ বিশেষ কেটে রক্তাক্ত জখম হয়। নরপশুরা ওই অবস্থায় কাজলীকে ধর্ষণ করে। যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা কাজলীর চিৎকারে তারা মা-বাবা অন্য ঘর থেকে ছুটে এলে সন্ত্রাসীরা তাকে ছেড়ে পালিয়ে যায়। এ সময় মুমূর্ষ অবস্থায় তাকে প্রথমে স্থানীয় ডাক্তারের কাছে পরে ডাক্তারের পরামর্শে রাজশাহীতে সেবা ক্লিনিকে নিয়ে চিকিৎসা করায়। আদালতের নির্দেশ মোতাবেক বাগমারা থানায় মামলা দায়ের করা হয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন/২০০০ এর ৯(১)/৩০ রজু হয়। মামলাটি তদনত্ম শেষে সকল আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এ মামলায় চার আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করে আদালত।
তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরীর দম্ভোক্তি: ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দেশজুড়ে ভয়ঙ্কর রূপে চলছে নির্বাচনোত্তর সহিংসতা। খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, সম্পদ লুট, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি-জামায়াত সশস্ত্র ক্যাডার। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী নির্দ্বিধায় অস্বীকার করছেন এ সকল ঘটনা। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর ও জনমতের চাপে সরকারী কর্মকর্তা ও দলীয় কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে হেলিকপ্টারযোগে বরিশালের আগৈলঝড়ায় যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সেখানে আয়োজিত এক মঞ্চে স্থানীয় সংসদ সদস্য জহিরউদ্দিন আহম্মেদ স্বপন বলেন, 'সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর কোন নির্যাতন না হওয়া সত্ত্বেও পত্রিকায় মিথ্যা প্রতিবেদন ছাপিয়ে সরকারকে হেয় করা হচ্ছে।' স্বপনের এই উক্তির সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চে উপস্থিত আলতাফ হোসেন চৌধুরীর সামনে হাজির হয় রাজিহার ইউপি সদস্য কমলা রানী ওরফে কালা বউ। কমলা রানী মঞ্চে উঠে উপস্থিত জনতার সামনে শাড়ি খুলে তার ওপর বিএনপি সন্ত্রাসীদের নির্যাতনের বর্ণনা দেন। পিনপতনের স্তব্ধতা ভেঙ্গে উপস্থিত জনতা ধিক্কার ধ্বনি দিয়ে মিথ্যাচারের প্রতিবাদ করে। কমলা রানী স্থানীয় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে পোলিং এজেন্ট ছিল বলে নির্যাতন করে তার বাড়ি সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত করে দেয়া হয়।
সূত্র: দৈনিক জনকণ্ঠ ১৫ জুন, ২০১১
No comments:
Post a Comment