সূত্রাপুরে সংখ্যালঘু পরিবারের ৯ জনকে অপহরণ করে বাড়ি দখলের চেষ্টা : গ্রেফতার ৪

নিজস্ব বার্তা পরিবেশক

পুরনো ঢাকার সূত্রাপুরে একটি সংখ্যালঘু পরিবারের ৯ সদস্যকে অপহরণ করে বাড়ি দখলের চেষ্টা চালিয়েছে সন্ত্রাসীরা। গতকাল শনিবার ভোরে সূত্রাপুর থানার অদূরে হৃষিকেশ দাস রোডের ৯৫ নম্বর বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে। সন্ত্রাসীরা পুলিশ পরিচয় দিয়ে ওই বাড়িতে ঢুকে লুটপাট চালিয়ে বাড়ির নারী-পুরুষ ও শিশুসহ ৯ জনকে অপহরণ করে পাশের একটি লোহা-লক্করের গুদামে বন্দি করে রাখে। পুলিশ টানা ৭ ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে গতকাল বেলা ১১টার দিকে অপহৃত ৯ জনকে উদ্ধার করেছে। এ ঘটনায় ৪ সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, একটি ডেভেলপার কোম্পানি দীর্ঘদিন ধরে জরাজীর্ণ ওই বাড়িটি ভেঙে নতুন এপার্টমেন্ট করতে চাচ্ছে। তারা এজন্য বিভিন্ন সময় বাড়ির মালিকদের নানাভাবে হুমকিও দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই ডেভেলপার কোম্পানির ভাড়াটিয়া লোকজনই হিন্দু পরিবারটিকে উচ্ছেদ করে বাড়িটি দখলে নেয়ার জন্য এ সন্ত্রাসী কর্মকা- চালাতে পারে বলে পুলিশ ধারণা করছে। এর সঙ্গে জড়িত ৪ সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ ব্যাপারে তাদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

পুলিশ ও ওই বাড়ির লোকজন জানায়, শুক্রবার রাত ৩টার দিকে ১৫/২০ জনের একটি অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী দল ৯৫ নম্বর হৃষিকেশ দাস রোডে অবস্থিত জরাজীর্ণ দোতলা বাড়িতে যায়। তারা নিজেদের ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে বাড়ির মালিক শম্ভুনাথ দাসকে দরজা খুলতে বলে। এর আগেই ওই বাড়িটির নিচ তলায় ভাড়াটিয়াদের দুটি বাসা বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে দেয় সন্ত্রাসীরা। পুলিশের কথা শুনে শম্ভুনাথ দরজা খুলে দিলে সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মুখে তাকে জিম্মি করে তার বাসায় তল্লাশি চালায়। সন্ত্রাসীদের অন্য একটি দল বাড়ির দোতলায় বসবাসকারী শম্ভুনাথের ছোট ভাই মহাবীর নাথ দাস এবং তাদের চাচাতো ভাই নিতাই চন্দ্র দাসের বাসায় ঢুকে তাদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে পুরো বাসায় তল্লাশি চালায় এবং তছনছ করে লুটপাট করে। এ সময় পরিবারের অন্য সদস্যরা তল্লাশির কারণ জানতে চাইলে সন্ত্রাসীরা জানায়, তারা ডিবি পুলিশের সদস্য। এ বাড়িতে অবৈধ মাদক ও অস্ত্র রয়েছে, তাই তল্লাশি করা হচ্ছে।

একপর্যায়ে শম্ভুনাথ দাস (৫০), তার স্ত্রী কাজল রানী দাস (৪২), ছেলে সজল দাস (১৪), মেয়ে মৌমিতা রানী স্বর্ণ দাস (৯), শম্ভুনাথ দাসের ছোট ভাই মহাবীর চন্দ্র দাস (৪৫), তার স্ত্রী লক্ষ্মী রানী দাস (৪০), দুই মেয়ে বিউটি রানী দাস (১৭), সুইটি রানী দাস (১২) এবং শম্ভুনাথ ও মহাবীর চন্দ্র দাসের চাচাতো ভাই নিতাই চন্দ্র দাসকে (৭০) অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাদের হাত-পা বেঁধে ও মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে অপহরণ করা হয়। সন্ত্রাসীরা তাদের ওই বাড়ির অদূরে ৮২ নম্বর হৃষিকেশ দাস রোডের জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের গোডাউনে বন্দি করে রাখে।

সূত্রাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তোফাজ্জল হোসেন জানান, রাত সাড়ে ৩টার দিকে থানায় মেসেজ আসে হৃষিকেশ দাস রোডের ৯৫ নম্বর বাড়িটিতে ডাকাতি হচ্ছে। এ খবরে ওই এলাকায় নৈশকালীন ডিউটিরত পুলিশের একটি দল ওই বাড়িতে যায়। পুলিশ ওই বাড়ির প্রত্যেকটি কক্ষ তছনছ অবস্থায় দেখে। এ সময় সন্দেহজনকভাবে বাড়ির ভেতর থেকেই ৪ যুবককে আটক করা হয়। আটককৃতরা হলো_ হুসাইন মোহাম্মদ বাবুল, আখতার হোসেন, নিজাম উদ্দিন সাগর ও মো. সোহাগ।

ওসি আরও জানান, বাড়িটির আশপাশের বাসার লোকজন পুলিশকে জানায়, রাতে পুলিশ পরিচয় দিয়ে ওই বাড়ি থেকে মালিকসহ তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ খবরে পুলিশ আটককৃতদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা বিষয়টি অস্বীকার করে। পরে তারা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের মুখে জানায়, ওই বাড়ির ৯ জনকে অপহরণ করে তারা জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপে আটকে রেখেছে। বেলা ১১টার দিকে পুলিশ তাদের জনতা ওয়ার্কশপ থেকে হাত-পা বাঁধা ও মুখে স্কচটেপ লাগানো অবস্থায় উদ্ধার করে।

স্থানীয় সূত্র জানায়, আটককৃত সন্ত্রাসীদের মধ্যে হুসাইন মোহাম্মদ বাবুল জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের মালিক। পুলিশ ওই ওয়ার্কশপটি তালাবদ্ধ করে দিয়েছে। আটককৃত চারজনই স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এ ব্যাপারে ৮০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের এক নেতা বিষয়টি স্বীকার করে সাংবাদিকদের জানান, আটককৃতরা আওয়ামী লীগের সমর্থক হলেও এ ধরনের অপকর্মের দায়িত্ব দল বহন করবে না। এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের বিচার হবেই।

এদিকে বাড়িটির মালিক শম্ভুনাথ দাস 'সংবাদ'কে জানান, উত্তরাধিকার সূত্রে তারা দু'ভাই এবং তাদের চাচাতো ভাই নিতাই চন্দ্র দাস ওই বাড়িটির মালিক। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে একটি ডেভেলপার কোম্পানি তাদের বাড়িটি কম দামে কেনার জন্য নানাভাবে পাঁয়তারা করে আসছে। একপর্যায়ে তারা জোর করে তাদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করার হুমকি দিয়ে আসছিল। বাড়ি দখলের জন্য এ গ্রুপটিই তাদের অপহরণ করতে পারে বলে তিনি জানান।

ওই রাতের বর্ণনা দিয়ে শম্ভুনাথ জানান, রাত ৩টার দিকে পুলিশ পরিচয় দিয়ে ১৫/২০ অস্ত্রধারী লোক তাদের বাড়িতে প্রবেশ করে। তারা পুলিশ পরিচয় দিয়ে বাড়িতে ঢুকে অস্ত্রের মুখে প্রত্যেকটি কক্ষে তল্লাশির নামে আলমারি ভেঙে তাদের বাড়ির খাজনা দেয়ার কাগজপত্রসহ বিভিন্ন মূল্যবান কাগজ এবং মোবাইল সেটসহ স্বর্ণালঙ্কার লুট করেছে। একপর্যায়ে তাদের মারধর করে হাত-পা বেঁধে ও মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে অপহরণ করা হয়। পরে তাদের জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপে আটকে রেখে অস্ত্রের মুখে সবার কাছ থেকে সাদা কাগজে সই নেয়া হয় বলে তিনি জানান।

অপহরণের শিকার মহাবীর চন্দ্র দাস ও তার স্ত্রী লক্ষ্মী রানী দাস জানান, সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মুখে তাদের জিম্মি করে বাড়ির দলিলপত্র খুঁজতে থাকে। এ সময় তাদের ছোট মেয়েরা আতঙ্কে কান্নাকাটি শুরু করলে সন্ত্রাসীরা জোর করে তাদের মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে দেয়। একপর্যায়ে তাদের সবার হাত-পা বেঁধে মারধর করা হয়। পরে ভোর ৪টার দিকে তাদের হাত-মুখ ও চোখ বেঁধে অস্ত্রের মুখে জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপে আটকে রাখে।

অন্যদিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের লালবাগ ক্রাইম জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. আনোয়ার হোসেন জানান, তারা মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছেন, বাড়িটি অবৈধ দখলের উদ্দেশ্যেই এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। একটি ডেভেলপার কোম্পানি ওই বাড়িটিসহ পাশের একটি মন্দির দখল করে বহুতল এপার্টমেন্ট নির্মাণের পাঁয়তারা করে আসছিল। এ ঘটনার সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টিও পুলিশ খুঁজে দেখছে। তবে এ মুহূর্তে তদন্তের স্বার্থে ওই ডেভেলপার কোম্পানির নাম বলতে তিনি অস্বীকৃতি জানান। তিনি জানান, আসল রহস্য উদঘাটনের জন্য গ্রেফতারকৃত ৪ জনকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ ঘটনায় থানায় মামলা করার প্রস্তুতি চলছে।

সংবাদ, ২৩ আগস্ট, ২০০৯

No comments:

Post a Comment