যুগান্তর রিপোর্ট
রাজধানীর সূত্রাপুরে শুক্রবার গভীর রাতে কোটি টাকার সম্পত্তি দখলের উদ্দেশে ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে হিন্দু পরিবারের মহিলা-শিশুসহ নয় জনকে অপহরণ করেছে সন্ত্রাসীরা। অপহরণের ৮ ঘণ্টা পর একটি গোডাউন থেকে অপহƒতদের উদ্ধার করেছে পুলিশ। অপহরণকারীরা বাড়ির দলিল, স্বর্ণালংকারসহ প্রায় ২ লাখ টাকার মালামাল লুট করেছে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে আওয়ামী লীগের চার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের সহায়তায় সন্ত্রাসীরা বাড়িতে হামলা চালায় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, রাত আড়াইটার দিকে ৯৫, ঋষিকেশ দাস রোডের রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর অফিস সহকারী শম্ভুনাথের ২য় তলা বাড়িতে ২৫-৩০ জনের একটি সন্ত্রাসী দল গিয়ে কলিংবেল টিপলে পরিবারের এক সদস্য গেটের দরজা খুলে দেন। সন্ত্রাসীরা ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। প্রত্যেকের হাতে ভারি আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। এ সময় পরিবারের সদস্যরা আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়েন। পরিবারের নয় সদস্যকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। বাসার পাশেই জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস নামে একটি গোডাউনে অপহƒতদের আটকে রাখা হয়। সন্ত্রাসীরা তাদের মারধর করে রক্তাক্ত করে ফেলে। অপহƒতরা হচ্ছেন- বাড়ির মালিক শম্ভুনাথ (৫০), তার স্ত্রী কাজল রানী দাস (৪২), সজল দাস (১৪), মহাবীর দাস (৪৫), লক্ষ্মী রানী দাস (৪০), বিউটি রানী দাস (১৮) ও সুইটি রানী দাস (১২), বৃদ্ধ নিতাই চন্দ দাস (৭০), মর্মিতা দাস ওরফে স্বর্ণা (৮)। অপহরণের সময় সন্ত্রাসীরা আলমারি ভেঙে বাড়ির দলিল, নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকারসহ প্রায় ২ লাখ টাকার মালামাল লুট করে।
বাড়ির আশপাশের লোকজন ডাকাত মনে করে চিৎকার শুরু করলে সন্ত্রাসীরা পুলিশ পরিচয় দিয়ে সবাইকে চুপ থাকতে বলে। পরে কেউ টঁু-শব্দ করারও সাহস পায়নি। খবর পেয়ে গতকাল ভোরে পুলিশ ঘটনাস্থলে ছুটে যায়। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা হোসাইন মোঃ বাবুল (৩২), সোহাগ (২৪), আক্তার হোসেন (২৭) ও নিজাম উদ্দিন সাগরকে (২৮) গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায়। তাদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করলে ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে। তাদের তথ্যের ভিত্তিতে শনিবার সকাল সোয়া ১১টার দিকে গোডাউনের ভেতর থেকে অপহƒতদের উদ্ধার করে পুলিশ। তাদের স্থানীয় একটি ক্লিনিকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।
বাড়ির মালিক শম্ভুনাথ জানান, তাদের ছয় শতাংশ সম্পত্তির ওপর দৃষ্টি পড়ে আনন্দধারা হাউজিং লিমিটেড নামে একটি ডেভেলপার কোম্পানির। ওই কোম্পানি বিভিন্ন সময় জায়গায় বহুতল ভবন নির্মাণের জন্য দালালদের মাধ্যমে বিক্রি করার প্রস্তাব দেয়। তাদের ওই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলে নানাভাবে হয়রানি করার চেষ্টা করে। পরে ডেভেলপার কোম্পানির লোকজন স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। যে প্রকারেই হোক বাড়িটি বিক্রি করতে হবে বলে হুমকি দেয় নেতাকর্মীরা। এ ঘটনার সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জড়িত। তিনি আরও বলেন, অপহরণের সময় পরিবারের সবাইকে মারধর করে। অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে সন্ত্রাসীরা। অস্ত্রের ভয়ে কোন কথা বলা সম্ভব হয়নি।
স্থানীয় বাসিন্দা শিল্পী রানী জানান, রাত ৩টার দিকে বাথরুমে যাওয়ার জন্য ঘরের দরজা খোলার চেষ্টা করলে দরজা বন্ধ পাওয়া যায়। এ সময় বাইর থেকে বলা হয়, তারা ডিবির লোক। কেউ ঘরের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারবেন না বলে হুমকি দেয়া হয়। সবার হাতে অস্ত্র ছিল। ডেভেলপার কোম্পানির লোকজন এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
অপহƒত লক্ষ্মী রানী দাস বলেন, রাতের বেলায় মুখে কালো কাপড় বেঁধে সন্ত্রাসীরা বাসায় প্রবেশ করে সবার মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে দেয়। এ সময় তাদের হাত-পা বেঁধে ফেলা হয়। গোডাউনের ভেতর আটকে রাখার পর একটি সাদা কাগজে সবার স্বাক্ষর নিয়ে নেয়। বাসায় থাকা জমির দলিল, নগদ টাকা, স্বর্ণালংকারসহ দুই লাখ টাকার মালামাল নিয়ে গেছে সন্ত্রাসীরা। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িটি দখলের পাঁয়তারা করে ডেভেলপার কোম্পানি। তিনি আরও বলেন, তার এইচএসসি পড়-য়া মেয়ে বিউটির ইজ্জত হরণের চেষ্টা করা হয়। গতকাল তার ব্যবহারিক পরীক্ষা ছিল। অপহরণের কারণে সে পরীক্ষা দিতে পারেনি।
বৃদ্ধ নিতাই চন্দ্র দাস জানান, এ ঘটনার সঙ্গে ডেভেলপার কোম্পানি ও আওয়ামী লীগের লোকজন জড়িত। দীর্ঘদিন ধরে হাউজিং কোম্পানি বাড়িটি কেনার চেষ্টা করে। মাঝে মধ্যে অজ্ঞাত সন্ত্রাসীরা বাড়িতে এসে হুমকি দিয়ে যেত। স্থানীয় সাংসদের সহযোগিতা চেয়েও কোন লাভ হয়নি। আবার সন্ত্রাসী হামলার আশংকা করছেন তিনি। নিতাই চন্দ্র বাসার সামনে একটি দোকান চালান। ওই দোকানেও হামলা চালাবে বলে সন্ত্রাসীরা হুমকি দিয়েছে। বাড়ির পাশে হিন্দুদের একটি উপাসনালয় রয়েছে। সেটিও দখল করার চেষ্টা করছে একটি মহল। বাড়ির ভাড়াটে কার্তিক চন্দ্র বলেন, বাইরে থেকে দরজা বন্ধ থাকায় তারা বের হতে পারেননি। বাড়ির মালিকদের অপহরণ করার সময় সন্ত্রাসীরা সবাইকে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দিলে কেউ চিৎকার ও এগিয়ে যাওয়ার সাহস পায়নি। পরে মোবাইল ফোনে পুলিশকে খবর দেয়া হয়।
৮০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি মোহাম্মদ আলী সাংবাদিকদের জানান, ঘটনার সঙ্গে আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মী জড়িত রয়েছে। তবে তাদের এ দুষ্কর্মের সঙ্গে দলের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই বলে তিনি দাবি করেন।
লালবাগ জোন পুলিশের উপ-কমিশনার মনিরুজ্জামান টুকু জানান, একটি ডেভেলপার কোম্পানি এ জায়গাটি দখল করার চেষ্ট করছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে। সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। তবে বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে।
সূত্রাপুর থানার ওসি তোফাজ্জল হোসেন জানান, গ্রেফতারকৃতরা স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী। পলাতক সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। বাড়ির মালিক বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেছেন।
যুগান্তর , ২৩ আগস্ট, ২০০৯
No comments:
Post a Comment