লুটেরাদের দখলে সংখ্যালঘুদের সম্পদ
।।ফনিন্দ্র সরকার।।
।।ফনিন্দ্র সরকার।।
এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর হুয়া দু বলেছেন, বাংলাদেশ কোনভাবেই অনিশ্চিত অবস্খায় যাবে না। এ নিয়ে কোন আশঙ্কা করাও নাকি ঠিক নয়। গত ৯ জুলাই বেসরকারি এক টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকারে তিনি এ মন্তব্য করেন। বাংলাদেশে ৬ বছরে দায়িত্ব পালন শেষে চলে যাওয়ার মুহূর্তে তিনি বাংলাদেশকে নিয়ে নতুন আশাবাদ ব্যক্ত করে গেলেন। ৬ বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বলেছেন, ১/১১- র আগে ফিরে যাওয়া কারও কাম্য নয়। বাংলাদেশ সঠিক পথেই এগুচ্ছে। তবে বাংলাদেশের সঠিক পথ যে কী, তা এদেশের সাধারণ মানুষ না বুঝলেও বিশ্বব্যাংক ও এডিবির কর্মকর্তারা ভাল করেই জানেন। যা হোক সংখ্যালঘুদের সম্পদ লুটেরাদের দখলে এ বিষয়বস্তুর সঙ্গে হুয়াদু’র মন্তব্যের কোন সামঞ্জস্য নেই বলে অনেকে মনে করতে পারেন। একটি বিশেষ সম্প্রদায় সব দিক থেকে নি:স্ব হতে চলেছে তারপরও বলা হচ্ছে দেশ সঠিক পথে এগুচ্ছে দেশ অনিশ্চিত অবস্খায় যাবে না বলে যে কথা বলা হচ্ছে তার মাজেজাই বা কী? দীর্ঘদিন ধরে এ দেশ তো অনিশ্চয়তার মধ্যেই হাবুডুবু খাচ্ছে। একটা দেশে যখন একটা সম্প্রদায় ভীষণভাবে লাঞ্ছিত হচ্ছে তা দেখেও কারও কোন প্রতিক্রিয়া হয় না, তখন হুয়াদু’রা এমন মন্তব্য করেন কীসের ভিত্তিতে?
১৯৪৭ সালের পূর্বে বাংলাদেশ ভারতবর্ষেরই একটি অংশ ছিল। ব্রিটিশ শাসনের কবল থেকে মুক্তির পর দ্বিজাতিতত্ত্বেবর ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়। সাম্প্রদায়িক দর্শনের আলোকে যে অংশটির ভাগ হয় সেটি পাকিস্তান। পাকিস্তানেরই একটি অংশ আজকের বাংলাদেশ। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানিদের পরাজিত করে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির জন্ম হয়। মনে করা হয়েছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সব নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত হবে। কিন্তু না! সেই যে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট থেকে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পদ লুট শুরু আজও তা অব্যাহত আছে। উপমহাদেশের বাংলাদেশ নামক এই অংশটুকুর ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি যে বিরামহীন নিপীড়ন চলে আসছে পৃথিবীর ইতিহাসে তা বিরল ঘটনা। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অনেকেই দেশ ছেড়েছে সহায় সম্পদ ফেলে।
যারা আছে তারাও সীমাহীন নিরাপত্তাহীন নি:স্ব অবস্খায় কোন রকমে প্রাণে বেঁচে থাকলেও নাগরিক মর্যাদা থেকে একরকম বঞ্চিত। কৌশলে রাষ্ট্রীয়ভাবেই এই সম্প্রদায়কে নি:স্ব করা হয়েছে। দরদ যা আছে তা শুধু মুখে মুখে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ২য় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করার অসৎ উদ্দেশ্যেই সংবিধান কাটা-ছেঁড়া করা হয়। ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল করা হয়। সংখ্যাগুরু মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্ম ইসলামকে করা হয় রাষ্ট্রধর্ম। কোন জাতি-গোষ্ঠীর ধর্ম কখন রাষ্ট্রধর্ম হয় না এই বোধ জ্ঞানটুকু শাসক এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা করে এদেশের সংখ্যাগুরু মুসলমানদের খুশি করতে পারলেও বাংলাদেশটাকে একটা খেলনা রাষ্ট্রে রূপান্তর করে ফেলেন। সংখ্যালঘুদের বানানো হয় খেলার পুতুল।
১৯৬৪ সালে তদানীন্তন পাকিস্তান সরকারের প্ররোচণায় পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। নারায়ণগঞ্জের ব্রহ্মপুত্র নদীকে রক্ত নদীতে রূপান্তর করা হয়েছিল। সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্ববৃহৎ তীর্থস্খান লাঙ্গলবন্দ অঞ্চলের হিন্দু সম্প্রদায়ের হাজার হাজার নারী-পুরুষ-শিশু হত্যা করে ব্রহ্মপুত্র নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। সারাদেশেই হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বর্বর আক্রমণ চলে। সে সময় ওই সম্প্রদায়ের বহু লোক দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেয়। তাদের ফেলে যাওয়া সম্পদ দখল করে নেয় লুটেরা গোষ্ঠী।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতে ১ কোটি শরণার্থী আশ্রয় নেয়, এদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। বলার অপেক্ষা রাখে না ১৯৭১ সালের যুদ্ধটি বাঙালির প্রতিপক্ষ অবাঙালি পাকিস্তানিরা হলেও যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানিদের মূল টার্গেট ছিল হিন্দু সম্প্রদায়কে ধ্বংস করা। পাকিস্তানি সেনারা এদেশের বাঙালি মুসলমানের সহযোগিতায় হিন্দু নিধনযজ্ঞ সাধন করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতে আশ্রয় নেয়া অনেক হিন্দুই থেকে যায়, যারা চলে আসে তাদের অনেকেই সম্পদ ফেরত পায় না। মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী অল্প কিছুদিনের ভেতরেই রূপ বদলে ফেলে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্পদ ফেরত দরের কথা ভিন্ন কৌশলে হিন্দুদের সম্পদ দখলের মহোৎসব শুরু হয়ে যায়। ১৯৬৫ সালের শত্রুসম্পত্তি আইন পরিণত হয় অর্পিত সম্পত্তি আইনে। অর্থাৎ পুরনো বোতলে নতুন মদ। মসজিদ, মাদ্রাসা কখনও মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের নামে শত শত বিঘা হিন্দু সম্পত্তি দখল করে নেয়া হয়।
গ্রামের হিন্দু কৃষকের জমি দিন দিন ছোট হতে থাকে। এক সময় পুরোটাই দখলে চলে যায়। ভূমি অধিদপ্তরে গিয়েও কোন প্রতিকার পাওয়া যায়নি। জমি সংক্রান্ত মামলায় সংখ্যালঘুর পক্ষে রায় ঘোষিত হলেও লুটেরাদের পেশিশক্তির কাছে হার মানতে হয়।
ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে গড়ে উঠেছে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের সম্পত্তি রাজধানী সুপার মার্কেট। টিকাটুলীর হাটখোলা রোডের এই বিশাল মার্কেটের জায়গাটিতে হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরি ছিল।
একজন সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের এই ভূ-সম্পদ কী করে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের সম্পত্তি হলো? পুরনো ঢাকার শাঁখারীবাজার, রায় সাহেব বাজার, গোয়ালনগর, তাঁতিবাজার এসব এলাকার ১ ইঞ্চি জমিও অন্য কোন সম্প্রদায়ের ছিল না। হিন্দু অধ্যুষিত এসব এলাকার পুরোটাই লুটেরাদের দখলে চলে গেছে। দখলের কৌশল হিসেবে আগে একটি ছোট মসজিদ তৈরি করা হয়। মসজিদের বিষয়টি স্পর্শকাতর। এটাকে কেন্দ্র করেই চলতে থাকে দখলদারিত্ব। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্রের সাহায্যেই চালান হয় নির্যাতন। সরকারি দপ্তরগুলোতে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শীর্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ পদের সংখ্যালঘুদের স্খান নেই। শীর্ষ দু-একটি পদে যারা আছেন তারাও ঠুঁটো জগন্নাথ। একেবারে ক্ষমতাহীন।
বাংলাদেশে যখনই কোন রাজনৈতিক সঙ্কট তৈরি হয় ঠিক তখনই সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের ভিন্নমাত্রা যোগ হতে থাকে। এরশাদ, জিয়া, খালেদা জিয়া এরা প্রত্যেকেই সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করার কৌশল অবলম্বন করে ক্ষমতায় টিকে থাকার নীতি গ্রহণ করত।
আওয়ামী লীগের তথাকথিত অসম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী দলে সিংহভাগ নেতা সংখ্যালঘুর সম্পদ দখল করে রেখেছে। সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দর্শন হচ্ছে চলে গেলেও জমি থাকলে ভোট। আওয়ামী লীগ সংখ্যালঘুদের তাদের পৈতৃক সম্পত্তি মনে করে। জনসংখ্যার অনুপাতে বাংলাদেশে অন্তত ৪০টি সংসদীয় আসন থাকার কথা। পাকিস্তান আমলের সংখ্যালঘু কোটা পদ্ধতি বাতিল করা হয়। বলা হয় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে সবাই বাংলাদেশী তাই আর কোটার দরকার নেই। সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সংসদীয় কোটার কোন বিকল্প নেই। স্বাধীনতার পর সংখ্যালঘুদের ওই অধিকারটুকু কেড়ে নেয়া হয়।
সংখ্যালঘুদের কথা বলার জন্য সংসদে কোন নেতৃত্ব না থাকলে তাদের অবস্খা বোঝার কোন সুযোগ থাকে না।
২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এসে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চালায়। মেয়েদের সম্ভ্রম লুট করা হলেও আজও তার কোন প্রতিকার হয়নি। হবে কী করে?
ওয়ান-ইলেভেনের একটি পরিবর্তন আসে, মনে করা হয়েছিল সংখ্যালঘুরা নিরাপদে দিনযাপন করতে পারবে। কিন্তু এদের ক্ষেত্রে কোন পরিবর্তন নেই। এখনও আগের মতোই এই সম্প্রদায় নিরাপত্তাহীনতায় আছে।
নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারও ওই একই নীতি অনুসরণ করছে। উপদেষ্টা পরিষদে সংখ্যালঘুদের কোন প্রতিনিধিত্ব নেই। প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায়স্পেশাল এসিসট্যান্ট টু চিফ এডভাইজার হিসেবে একজন নিরীহ আমলাকে নেয়া হয়েছে শুধু নিয়ম রক্ষার জন্য। আসলে ওই সংখ্যালঘু ব্যক্তিটির কোন ক্ষমতাই নেই। বেছে বেছে এই ধরনের হিন্দুদেরই মন্ত্রিত্ব দেয়া হয়। যে ব্যক্তি সংখ্যালঘু হিন্দুদের স্বার্থরক্ষার ভেতরে থেকে কাজ করে পরবর্তীতে তাকে কোন পদ দেয়া হয় না। এই হচ্ছে অবস্খা। আগে থেকেই পরিকল্পিতভাবে হিন্দু সম্প্রদায়কে নির্যাতনের ছক তৈরি করা হয়। কতিপয় লোককে নানাভাবে প্রলোভন দেখিয়ে দালাল তৈরি করা হয়। সেই দালালরা নিজেদের স্বার্থরক্ষায় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে।
আজ আমাদের সময় এসেছে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার। আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ হতে পারি তবে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার একটা রাস্তা তৈরি হতে পারে। এখন দাবি হবে একটাই হিন্দুদের সম্পদ ফিরিয়ে দাও। যারা সম্পদ ভোগ করছে সুদে-আসলে ফেরৎ নেয়ার ব্যবস্খা করতে হবে। স্বাধীন দেশে পরাধীনতার গ্লানি নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যুই শ্রেয়। হয় বাঁচার মতো বাঁচবে নয়তো বীরের মতো আন্দোলন করে প্রাণ বিসর্জন দেব।
উল্লেখ্য, ১৯৬৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রায় ১৬ লাখ একর ভূমি বেদখল হয়েছে। এর মধ্যে ১০ হাজার মন্দিরের জায়গা রয়েছে। মন্দির, শ্মশানের হাজার হাজার একর জমি লুটেরারা জোরপর্বক দখল করে রেখেছে। দখলদার বাহিনীর অধিকাংশই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও প্রভাবশালী আমলা রয়েছে। সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি লুটপাটের ইতিহাস পৃথিবীর আর কোন দেশেই সৃষ্টি হয়েছে বলে জানা নেই। পাঠক আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে শৈবাল সাহা পার্থ নামক এক সংখ্যালঘু তরুণের জীবন কীভাবে বিপন্ন করা হয়েছে। গত জোট সরকারের আমলে শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টার আনীত অভিযোগে নির্মমভাবে শিক্ষিত ওই তরুণকে অত্যাচার করা হলেও রাজনৈতিক দলের কোন মহল থেকেই জোরাল প্রতিবাদ হয়নি।
একটি মিথ্যা অভিযোগ এনে জোট সরকার শেখ হাসিনার প্রতি মায়াকান্না দেখালেও জননেত্রী শেখ হাসিনাও এর প্রতিবাদ করেননি কারণ ওই যুবকটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছিল বলে। আজ ওই পার্থ সাহা পঙ্গুত্ববরণ করে কোন রকমে বেঁচে আছে। কেউ কী তার স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে পারবে না। ওই ছেলেটির বিপন্নতায় গোটা পরিবারই বিধ্বস্ত। কত স্বপ্ন ছিল তাদের। এটা তো শুধু একটি উদাহরণ মাত্র। এরকম শত শত ঘটনা ঘটেছে এবং ঘটেই চলেছে এই স্বাধীন বাংলাদেশে। অতএব এবার জীবনবাজি রেখেই রুখে দাঁড়ানোর পালা।
দৈনিক সংবাদ। ২২ জুলাই ২০০৮
No comments:
Post a Comment