মঙ্গলবার, ১২ মার্চ ২০১৩, ২৮ ফাল্গুন ১৪১৯
নোয়াখালীর সন্ত্রাস কবলিত গ্রাম থেকে ফিরে ২
মহিউদ্দিন আহমেদ, নোয়াখালী রাজগঞ্জ থেকে ফিরে ॥ মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে হযরত মুহম্মদ (স) ঘোষণা করেছিলেন, যারা নিজ নিজ ঘরে অবস্থান করবে, তারা নিরাপদ থাকবেন। যারা আবু সুফিয়ান (ইসলামের চরম দুশমন) কিংবা তার সঙ্গীদের ঘরে অবস্থান নেবে তারাও নিরাপদ থাকবেন। যারা পবিত্র কাবা শরীফে অবস্থান নেবেন, তারাও নিরাপদ থাকবেন। জামায়াতে ইসলামী নিজেদের ইসলামী দল পরিচয় দিয়ে থাকলেও নিজেদের স্বার্থ হাসিলে ঘর থেকে মানুষ বের করে অগ্নিসংযোগ, লুটপাটসহ ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। তাদের ভয়ে ঘুমে থাকা ২ মাসের শিশু ও শত বছরের বৃদ্ধাকে কোলে নিয়ে পালাতে হয়েছে অভিভাবকদের। মন্দির থেকে শ্মশান সব জায়গায় ভাংচুর করেছে জামায়াত-শিবির ও তাদের দোসররা। শনিবার সরেজমিন নোয়াখালী রাজগঞ্জের আলাদি গ্রাম ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে।
২৮ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালীর রাজগঞ্জের আলাদীনগর গ্রামে সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মন্দির ভাংচুর এবং লুটপাট চালায় যুদ্ধাপরাধের কারণে ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়কে কেন্দ্র করে। সেখানে সংখ্যালঘুদের ওপর তাণ্ডবলীলা চালায় কথিত ইসলামী সংগঠন জামায়াত-শিবির। তাদের নির্মম নির্যাতন শিকার ২ মাসের নিষ্পাপ শিশু থেকে ১০৫ বছরের বৃদ্ধ। স্বর্ণালঙ্কার থেকে রান্নার পাতিল পর্যন্ত লুট করে নিয়েছে জামায়াত-শিবির ও বিএনপি নেতাকর্মীরা। ঘর, ওষুধ কারখানা, বাড়ির গাছ-গাছালি পুড়ে ছাই করেছে স্বাধীনতাবিরোধী এ চক্র। কবুতর থেকে গবাদিপশু পর্যন্ত রক্ষা পায়নি তাদের নির্যাতনের হাত থেকে। ভাংচুর করা হয়েছে ধর্মীয় উপাসনালয় মন্দির থেকে শুরু করে সমাধিস্থল শ্মশান পর্যন্ত।
ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন মালিবাড়ির প্রীতি রানী। তিনি বলেন, ঘটনার দিন দুপুরের খাওয়া শেষে দুইটার দিকে হঠাৎ বিশাল একটি মিছিল রামদা, কুড়াল, দা বঁটি, বড় বড় লাঠি, আগুনের মশাল নিয়ে তাদের বাড়ির দিকে আসতে থাকে। এমন কিছু অস্ত্র হামলাকারীদের হাতে দেখা গেছে তিনি ওইসব অস্ত্র কখনও দেখেননি। ঘটনাটি বুঝে ওঠার আগে রাস্তা থেকে বাড়িতে ঢুকে পড়ে মিছিলকারীরা। ঢুকেই ঘরের টিনে কোপাতে এবং এলোপাতাড়ি লাঠি দিয়ে আঘাত শুরু করে। প্রাণভয়ে তিনি পাশের বাড়িতে আশ্রয় নিতে দৌড়তে শুরু করেন। এর মধ্যে দেখেন তার ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে তার ঘর। তার ঘরের মতো এই বাড়ির সব ঘরেই একইভাবে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। তবে ঘরে আগুন দেয়ার আগে ঘরের ভেতরে থাকা গুরুত্বপূর্ণ পণ্য একটি গ্রুপ বের করে নেয়। একই বাড়ির আরেক বাসিন্দা নকুল চন্দ্র দাস। তিনিও একইভাবে ঘটনার দিনের নির্মম দৃশ্য বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, পাশের মুসলিম পরিবার, ফরহাদ ও ফারুকদের ঘরে এ বাড়ির সবাই আশ্রয় নেন। কিন্তু হামলাকারীরা ওই বাড়িতে বাড়ির মালিকদের হুমকি দিতে থাকে হিন্দুদের ঘর থেকে বের করে না দিলে তাদের ঘরেও আগুন দেয়া হবে। তবে ওই মুসলিম পরিবারটি ঝুঁকি নিয়ে মালিবাড়ির হিন্দুদের আশ্রয় দেন। এ বাড়িতে ২ মাসের একটি শিশু আছে অথৈ নামের। শিশুটি জন্মের দুই মাসের মাথায় জামায়াত-শিবিরের নির্মম আক্রমণের শিকার হলো। যদিও এখনও সে এ বিষয়টি বোঝার বয়স হয়নি অথৈর। হামলার সঙ্গে সঙ্গে ছোট মেয়েকে নিয়ে ঘর থেকে বের হতে একটু বিলম্ব হলে তাকে সন্তানসহ হামলাকারীরা জোর করে ঘর থেকে বের করে আগুন ধরিয়ে দেয় ঘরে। অথৈর মায়ের কাছে বাচ্চার নাম জানতে চাইলে বলে ওঠেন, ‘নাম দি কি করব হেদিন হোয়া যাইত।’ তিন বছরের নিচে ৪টি বাচ্চা ছিল এ বাড়িতে। হামলার সঙ্গে সব শিশু ভয়ে চিৎকার করে কান্না করতে থাকে। কিন্তু এ ছোট শিশুদের জামায়াত-শিবির কর্মীদের হৃদয় স্পর্শ করেনি। তারা দস্যুদের মতো লুটপাট-ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ করেছে নির্বিচারে।
পাশের পশ্চিম দক্ষিণ দিকে আরেকটি ঘরে থাকেন ৮৫ বছরের বৃদ্ধা শিশুবালা। তিনিও রেহাই পাননি জামায়াত-শিবির ও বিএনপি নেতাকর্মীদের নির্যাতন থেকে। কোন রকম আটকাতে পারলেও দৌড়ে প্রাণ রক্ষা করার মতো শক্তি নেই শিশুবালার। তাই নাতি রাজিব তাঁকে কোলে করে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নেন। ওই দিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে দুই চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে শিশুবালার। আর আস্তে শুধু বলেন, ‘সব হোড়াই দিছে’ রাজিব আঁরে না নিলে, আই মরি যাইতাম।’
একই গ্রামের বিমল কান্তি ঠাকুর বাড়িতে তাণ্ডবের বর্ণনা দেন বিপ্লব কুমার। তিনি বলেন, আগুন দেয়ার ধরনটা সব বাড়িতে একই রকম ছিল। যখন বাড়িতে তারা প্রবেশ করে এর আগে জানতে পারে পাড়ার হিন্দু বাড়িগুলো জ্বালিয়ে দিচ্ছে জামায়াত-শিবির। তাদের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীরাও আছেন। তাই তাঁরা সম্পদের আশা ত্যাগ করে প্রাণ নিয়ে আগে পালাতে থাকেন ঠাকুরবাড়ির বাসিন্দারা। আর এ সুযোগে এ বাড়ির ঘরগুলোতে আগুন দেয়ার আগে সব ঘর থেকে নগদ টাকা, কয়েকভরি স্বর্ণ ও দামী আসবাবপত্র লুট করে নেয় হামলাকারীরা। গঙ্গা প্রসাদ বাড়িতেও লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের বিষয়ে কথা হয় শ্যামলী চৌধুরীর সঙ্গে। এ বাড়িটিতে ১৫/১৬ জন মানুষের মধ্যে মাত্র দুজন পুরুষ আছে। আর সব নারী। এ বাড়িটিতে সব ঘর পুড়িয়ে দিয়েছে জামায়াত-শিবির ও তাদের দোসররা। যে ঘর থেকে নারীরা বের হতে বিলম্ব হয়েছে নারীদের মারধর করে ঘর থেকে বের হতে বাধ্য করে। ঘর পোড়ানোর আগে অন্য ঘরের মতো লুটপাট করতে ভুল করেনি তারা। শ্যামলী চৌধুরীর ঘরে ৫০ হাজার টাকা, সাড়ে তিন ভরি স্বর্ণ ও কয়েকভরি রূপা ছিল। সবকিছু নিয়ে যায় হামলাকারী দস্যুরা। এ বাড়িতে গঙ্গা প্রসাদ নামের একটি ২০০ বছরের পুরাতন কবিরাজি ওষুধ তৈরির কারখানা ছিল, সেই কারখানাটিও পুড়িয়ে দেয়া হয়। এ বাড়ি থেকে বের হয়ে আসার সময় কথা হয় পল্লী চিকিৎসক সঞ্জয়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, ঘটনার দিন তিনি হামলাকারীদের মিছিলের সামনে পড়ে যান। তাঁকে মেরে ফেলার জন্য ধাওয়া দিতে থাকে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। তিনি দৌড়ে আশ্রয় নেন জাহাঙ্গীর নামে এক মুসলিমের ঘরে। তাঁকে ধাওয়া দিয়ে ওই মুসলিম পরিবারের ঘরে ঢুকে দীর্ঘক্ষণ খোজাখুঁজি করা হয়। চৌকির নিচে পালিয়ে ওইদিন জীবন রক্ষা করেন সঞ্জয়। ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে সঞ্জয় বলেন, ‘ভাই আঁই মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচি আইছি’ তিনি বলেন যারা আঁরে মাইরতো চাইছে তারা আঁর পরিচিত ছিল।’ এলাকা ঘুরে দেখা যায় যেসব বাড়িতে আগুন দেয়া হয়েছে সব বাড়িতে পোড়া টিনের স্তূপ। তা ছাড়া বাড়ির গাছগাছালি পুড়ে গেছে। মালিবাড়ির এ গৃহবধূ জানান, জামায়াত-শিবিরে হামলা শুধু যে লুটপাট, নির্যাতন ও অগ্নিসংযোগের মধ্যে সীমাবদ্ধতা ছিল না, তারা বাড়ির গবাদিপশুর ওপরও হামলা করেছে। টঙ্গিপাড়ার গঙ্গা প্রাসাদ ভুইয়া বাড়ির প্রাণগোপাল শ্মশান নামফলকও ভাংচুর করা হয়। একই স্থানের দূর্গাপ্রসন্ন ভুইয়ার শ্মশানের নামপলকও ভাংচুর করা হয়। হামলাকারীদের তাণ্ডব থেকে শ্মশানও রক্ষা পায়নি রাজগঞ্জ এলাকায়। ২৮ ফেব্রুয়ারি তাণ্ডবের আওতায় ওই এলাকার ৬২ পরিবারের ৭৫টি বাড়িঘর ও দোকানপাটে ধ্বংসলীলা চালানো হয়। ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয় ৬টি মন্দিরে। জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডবে ধাতব নির্মিত টিনও অঙ্গারে পরিণত হয়েছে। লুটপাট করা হয়েছে নগদ অর্থ, স্বর্ণ, রৌপ্য, তামা, কাসা-পিতলের তৈজসপত্র, রেডিও, টেলিভিশনসহ মূল্যাবন আসবাবপত্র। ওই এলাকায় বেশিরভাগ বাড়িতে ২ থেকে ৭ ভরি সোনা ও রূপার অলঙ্কার ছিল। যা লুট করে নিয়ে যাওয়া হয় বলে জানান স্থানীয়রা। এলাকার তাণ্ডবের ঘটনা বর্ণনা করে স্থানীয়রা জানান ওইদিন ওই এলাকায় পুলিশ যদি গুলিবর্ষণ না করতো তা হলে হিন্দুদের বাঁচার উপায় ছিল না।
দৈনিক জনকণ্ঠ। লিংক
No comments:
Post a Comment