শ্যামল সিলেট ডেস্ক :
কয়েকটি মন্দির ভাঙচুরের পর উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে ১৪৪ ধারা জারি করেছে স্থানীয় প্রশাসন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত হাটহাজারী উপজেলা সদর ও নন্দীরহাটে কয়েকটি মন্দির ভাঙচুর এবং আগুন দেওয়ায় জামাত-শিবিরের ইন্ধন রয়েছে বলে স্থানীয়রা দাবি করেছেন। (সূত্র : বিডিনিউজটুয়েন্টিফোর.কম)
বৃহস্পতিবার সকালের একটি ঘটনা থেকে এই উত্তেজনার সূত্রপাত হয়। মন্দিরের পাশাপাশি স্থানীয় হিন্দুদের বাড়ি ও দোকানেও হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতারা পরিস্থিতি এত দূর গড়ানোর জন্য প্রশাসনের উদাসীনতাকে দায়ি করেছেন।
হিন্দুরা বলছেন, একটি গুজবের ওপর ভিত্তি করে মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুর চালানো হয়। অন্যদিকে মসজিদে হামলার অভিযোগ তুলে এর জন্য দায়িদের শাস্তির দাবিতে দিনভর হাটহাজারীতে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়ক অবরোধ করে রাখে এক দল লোক।
দিনভর উত্তেজনার পর প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী আফসারুল আমীন, নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুছ ছালাম, নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ইব্রাহীম হোসেন চৌধুরী বাবুল শুক্রবার দুপুরের পর হাটহাজারী গিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করেন।
আফসারুল আমীন সাংবাদিকদের বলেন, একটা ভুল বোঝাবুঝির কারণে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। হাটহাজারীর বিভিন্ন পাড়ায় মন্দির-মসজিদে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক থাকবে।
চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহম্মদ বলেন, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত উপজেলায় ১৪৪ ধারা জারি থাকবে। ১৪৪ ধারা জারির ফলে কোথাও বেশি মানুষ জড়ো হলে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে। ঘটনার শুরু হয় বৃহস্পতিবার। সকালে নন্দীর হাট এলাকায় লোকনাথ সেবাশ্রম মন্দিরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ছিল। এই উপলক্ষে হিন্দু স¤প্রদায়ের লোকজন ও মন্দিরের ভক্তরা একটি শোভাযাত্রা বের করে। এতে উৎসবের অংশ হিসেবে মাইকের পাশাপাশি ঢোলও বাঁজানো হচ্ছিল।
স্থানীয়রা জানায়, শোভাযাত্রা স্থানীয় একটি মসজিদ অতিক্রমের সময় মসজিদের মুসল্লিরা ঢোল বাঁজাতে নিষেধ করে। এক পর্যায়ে মিছিলের পেছন দিকে ঢিল ছোঁড়া হয়। তখন শোভাযাত্রা থেকে পাল্টা একটি ঢিল ছুড়লে তর্কাতর্কি ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হয়।
এরপর সমস্যা সমাধানে পুলিশ দুই সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয়দের নিয়ে বৈঠক বসে। তবে ওই বৈঠক শুরু করতে উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে কালক্ষেপণ করা হয় বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। মুসলমান সম্প্রদায়ের এক দল বলে, বৈঠকের স্থান হবে মসজিদ। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এতে রাজি হলে সন্ধ্যায় এই বৈঠক শুরু হয়।
বৈঠকে অংশ নেওয়া কয়েকজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বৈঠক চলাকালেই একদল দুবৃর্ত্ত লোকনাথ মন্দিরে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। মন্দিরে আসা বিভিন্ন দর্শণার্থীর সাত-আটটি গাড়িও ভাঙচুর করে তারা।
পূজা উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক অশোক কুমার দেব বলেন, সকালের ঘটনার পর কেউ গিয়ে মসজিদে কাঁচ ভেঙে দেয়। তারপর এলাকায় গুজব ছড়ানো হয়, হিন্দু সম্প্রদায় মুসলমানদের মসজিদ ভেঙে ফেলছে। এরপর শুক্রবার সকালে হাটহাজারী এবং আশপাশের এলাকার বিভিন্ন মাদরাসার ছাত্রদের জড়ো করে মাইকে ঘোষণা দিয়ে কয়েকটি মন্দির ভাঙচুর এবং হিন্দুদের দোকানপাটে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট চালানো হয়।
শুক্রবার নন্দীরহাট ঘুরে তিনটি মন্দিরে ভাঙচুরের চিহ্ন দেখা গেছে। এগুলো হলো- শ্রী শ্রী মগদেশ্বরী মায়ের মন্দির, জগন্নাথ বিগ্রহ মন্দির ও লোকনাথ মন্দির। এর মধ্যে মগদেশ্বরী মন্দিরে আগুনও দেওয়া হয়। এছাড়া হাটহাজারী উপজেলা সদরে কালীবাড়ি মন্দিরেও ভাঙচুরের চিহ্ন দেখা গেছে। হামলা থেকে হিন্দুদের বাঁচাতে গিয়ে আহত দক্ষিণ পাহাড়তলীর সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার জাফর আলম চৌধুরী বলেন, হামলাকারীরা কেউ এলাকার লোক নয়। প্রায় ২০ বছর ধরে কমিশনারের দায়িত্ব পালনকারী জাফরের মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাটহাজারী বাজারে হিন্দুদের সোনার দোকানে লুটপাটকারীরাও এলাকার নয় বলে স্থানীয়রা জানিয়েছে।
স্থানীয় অনেকেই বলছেন, সাম্প্রদায়িক একটি গোষ্ঠী এই ঘটনায় ইন্ধন দিচ্ছে। এলাকাটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি হওয়ায় এখানে ইসলামী ছাত্রশিবিরের অনেক নেতাকর্মী মেস করে কিংবা বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে লজিং থাকে।
মন্দির ভাঙচুরের মাধ্যমে পরিস্থিতিকে অস্থির করতে স্থানীয় জামাত-শিবিরের ইন্ধন রয়েছে বলে মনে করছেন চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের প্রশাসক এম এ সালামও। আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার পর জামাত-শিবির পরিস্থিতি অস্থির করতে ইন্ধন যোগাচ্ছে।
হাটহাজারীর নন্দীরহাট থেকে তিন কিলোমিটার দূরের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বুধবার ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের সংঘর্ষে দুই ছাত্র নিহত হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া দেশের সবচেয়ে বড় মাদরাসাটি এই হাটহাজারী এলাকাতেই, যেখানে শিবিরের শক্ত অবস্থান রয়েছে। বৃহস্পতিবারের পর উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় ওই এলাকায় যথেষ্ট সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়নি বলে মনে করেন সালাম। শুক্রবার সকাল থেকে হাটহাজারীতে সড়ক অবরোধ করে স্থানীয় মুসল্লিরা। হাটহাজারী থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার আগে (চট্টগ্রামের দিকে) দুপুরে সড়কের ওপর জুমার নামাজও পড়া হয়।
সকালে পরিস্থিতি শান্ত করতে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আনিসুল ইসলাম মাহমুদ নন্দীর হাট গিয়েছিলেন। কিন্তু বিফল হয়ে ফেরেন তিনি। দুপুরের পর মন্ত্রী আফসারুল আমীন প্রথমে নন্দীরহাট যান। সেখান থেকে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়ে হেঁটে হাটহাজারী উপজেলা সদরে যান তিনি। পথে তিনি আশেপাশের লোকজনকে শান্ত থাকার অনুরোধ জানান। এরপর সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে অবরোধ উঠে গেলে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়কে গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক হয়। হাটহাজারীতে ৫০০ পুলিশ, চার প্লাটুন বিজিবি সদস্য নিরাপত্তা মোতায়েন করা হয়েছে। ব়্যাব সদস্যরা টহলে রয়েছে। হাটহাজারী থানা বিএনপির সভাপতি এস এম ফজলুল হক পরিস্থিতির অবনতির জন্য প্রশাসনিক ব্যর্থতাকে দায়ি করেন। তিনি বলেন, প্রশাসন শুরু থেকে তৎপরত থাকলে পরিস্থিতি এত দূর গড়াত না।
এলাকায় সম্প্রীতি রক্ষায় বিএনপির সব নেতাকর্মীদের কাজ করতে বলা হয়েছে জানিয়ে ফজলুল বলেন, এখন সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে। এদিকে মন্দিরে হামলার পর লোকনাথ আশ্রমের ওই উৎসব আর হচ্ছে না। মন্দির প্রাঙ্গণে বিপুল সংখ্যক ব়্যাব ও পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
দৈনিক শ্যামল সিলেট
No comments:
Post a Comment