নিজস্ব প্রতিবেদক
রাতের অন্ধকারে প্রাচীন ভবন দখল করার জন্য একই পরিবারের নয়জনকে অপহরণ করেছে একদল দুর্বৃত্ত। তারা ওই বাড়িতে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালিয়েছে। অপহূত ব্যক্তিদের গতকাল শনিবার সকাল ১০টার দিকে একটি ছোট কারখানা থেকে উদ্ধার করেছে সূত্রাপুর থানার পুলিশ।
পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের ৯৫ নম্বর হূষিকেশ দাস লেনে এ ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাঁরা হলেন ৮২ নম্বর হূষিকেশ দাস লেনের মোহাম্মদ ইসমাইল, ৪১/এ ঠাকুরদাস লেনের মোহাম্মদ সোহাগ, পদ্মনিধি লেনের আক্তার হোসেন ও নন্দলাল দাস লেনের মোহাম্মদ নিজামুদ্দিন।
পুলিশ জানিয়েছে, দুবর্ৃত্তদের ৯৫ নম্বর হূষিকেশ দাস লেন থেকে রাতেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল দুপুরের পর পর অপহূত তিন ভাই নিতাই চন্দ্র দাস, শম্ভুনাথ দাস ও মহাবীর দাস এবং কাজল রানী দাস, লক্ষ্মী রানী দাস, বিউটি, সুইটি, ঝর্ণা ও সজল বাসায় ফিরে গেছেন। বাসায় গিয়ে তাঁরা তাঁদের দুই লাখ টাকা ও ১৪ ভরি স্বর্ণালংকার লুট হওয়ার কথা জানিয়েছেন। ওই পরিবারের নিরাপত্তার জন্য ভবনটিতে এখন পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পুলিশের ঊধ্র্বতন কর্মকর্তা, মহানগর পূজা কমিটির নেতারা এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
ঘটনার বিষয়ে সহকারী পুলিশ কমিশনার (ডেমরা) মো. মনিরুজ্বামান প্রথম আলোকে বলেন, এটি পূর্বপরিকল্পিত, ভূমিদস্যুরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। মহানগর পূজা কমিটির নেতা নির্মল চ্যাটার্জি ও তাপস কুমার পাল ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, রাজধানীর বুকে সংখ্যালঘু পরিবারকে এভাবে অপহরণ করে তাঁদের বাড়ি ও মন্দির দখলের ঘটনা প্রমাণ করে কী ধরনের নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে তাঁরা বসবাস করছেন। তিনি এ ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন।
পুলিশ ও অপহূত পরিবারের সদস্যরা জানান, এ ঘটনার পেছনে তাঁদের চার কাঠা জমি দখলই মূল উদ্দেশ্য। নিতাই চন্দ্র দাস বলেন, দুর্বৃত্তরা তাঁদের একটি কারখানায় নিয়ে সারা রাত হাত-পা বেঁধে আটকে রাখে। সকালে তাঁরা একটি সই দিলে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে। এরপর একটি সাদা কাগজ আনে, তবে এতে তাঁরা ভুল স্বাক্ষর করেন। কিন্তু এর পরও তাঁদের আটকে রাখা হয়। পরে গতকাল সকাল ১০টার দিকে পুলিশ গিয়ে তাঁদের উদ্ধার করে।
পুলিশ ও স্থানীয় লোকজন সন্দেহ করছে, ভবনটির পেছনে একটি হাউজিং সোসাইটি বহুতল ভবন নির্মাণ করছে। কিন্তু অপহূত তিন ভাইয়ের ৯৫ হূষিকেশ দাস লেনের বাড়ি ও মন্দিরটি সড়কসংলগ্ন হওয়ায় ভবনটির প্রতি তাদের নজর পড়তে পারে। জানা গেছে, এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি বানিয়ানগরের ১, ২, ৩ ও ৪ নম্বর বাড়িটি নিয়ে নিয়েছে। এখন এই বাড়িটি তাদের মধ্যে চলে এলেই পুরোটা তাদের হয়ে যায়। কিন্তু নিতাই চন্দ্র দাস, শম্ভুনাথ দাস ও তাঁর ভাই এতে কিছুতেই রাজি ছিলেন না। এ কারণেই তাঁদের অপহরণ করে বাড়িটি লিখে নেওয়ার ষড়যন্ত্র হতে পারে।
পুলিশের উপকমিশনার (ওয়ারী) প্রলয় চিসিম বলেন, গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করলেই বিস্তারিত তথ্য বেরিয়ে আসবে। ধারণা করা যাচ্ছে, তাদের কেউ টাকা-পয়সা দিয়ে এ ঘটনা ঘটাতে বলেছে।
লুটপাট ও তাণ্ডব: এর আগে তাঁদের অপহরণ করতে গিয়ে দুর্বৃত্তরা রীতিমতো তাণ্ডব চালায় ওই বাড়িতে। গতকাল সকালে সেখানে গিয়ে তাণ্ডবের চিহ্ণ দেখা যায়। একটি শিশু একটি একটি করে টাকা জমাত ছোট্ট একটি মাটির ব্যাংকে। ব্যাংকটি ভেঙে টাকা নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। চিনামাটির প্লেট ভাঙা পড়ে আছে। স্টিলের আলমারির ড্রয়ার ভাঙা। জানা গেছে, সব মিলিয়ে দুর্বৃত্তরা তিন ভাইয়ের দুই লাখ টাকা এবং ১৪ ভরি স্বর্ণালংকার লুট করেছে। তাঁদের পরিবারের নারী সদস্যদের সঙ্গে দুর্বযবহার করা হয়েছে বলেও তাঁরা জানিয়েছেন।
ঘটনার শুরু: পুলিশ, প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, গত শুক্রবার গভীর রাতে (আড়াইটা থেকে তিনটা) হঠাৎ বাসার সামনে তাঁরা ৮-১০ জন মানুষের উপস্থিতি টের পান। আগত ব্যক্তিরা নিজেদের পুলিশের লোক পরিচয় দিয়ে কোনো চিৎকার করতে নিষেধ করে দরজা খুলতে বলে। অপহূত ৭০ বছর বয়সী নিতাই চন্দ্র দাস বলেন, ‘আমি ওদের গতিবিধি খারাপ বুঝতে পেরে পেছনের দরজা খুলে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করি। এ সময় ওরা দরজা ভেঙে আমাকে ধরে ফেলে এবং হাত বেঁধে মুখ টেপ দিয়ে আটকে দেয়।’
মহাবীর দাস বলেন, এভাবে এক এক করে তাঁর দুই ভাই, দুই ভাইয়ের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদেরও হাত বাঁধে ও মুখ টেপ দিয়ে বন্ধ করে দেয়। এরপর কাছেই জনতা ওয়ার্কশপে নিয়ে সারা রাত আটকে রাখে। পুলিশ জানিয়েছে, জনতা ওয়ার্কশপের মালিক হচ্ছেন গ্রেপ্তার হওয়া ইসমাইল মোহাম্মদ।
ওই বাড়ির ভাড়াটিয়া কার্তিক দাস ও তাঁর পরিবারকে বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আমাকেও পুলিশের লোক পরিচয় দিয়ে বাইরে থেকে আটকে রাখে। তবে আমার কাছে সূত্রাপুর থানার পুলিশের নম্বর ছিল। আমি সারা রাতই একটার পর একটা মেসেজ পাঠিয়েছি পুলিশকে।’ এরপর সূত্রাপুর থানার পুলিশ ওই চারজনকে গ্রেপ্তার করে।
ঘটনার ব্যাপারে সূত্রাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তোফাজ্বল হোসেন বলেন, এ ব্যাপারে কাউকে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ গতকাল রাতে এই প্রতিবেদন লেখার সময় পুলিশ মামলা করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
প্রথম আলো, ২৩ আগস্ট, ২০০৯
No comments:
Post a Comment