নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় সারা দেশে ৭০ জন আহত, সংখ্যালঘুদের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর

প্রথম আলো ডেস্ক

দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। খুলনায় বিএনপি-জামায়াত ও আওয়ামী লীগের সমর্থকদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলায় ২৫ জন আহত হয়েছে। বাগেরহাট ও পাবনায় বিএনপির নেতার ওপর প্রতিপক্ষ হামলা চালিয়েছে। ভাইয়ের ওপর হামলার দৃশ্য দেখে পাবনায় একজনের মৃত্যু হয়েছে। রাজশাহীসহ কয়েকটি জায়গায় পাল্টাপাল্টি হামলা এবং সংখ্যালঘু পরিবারের বাড়িতে হামলার অভিযোগ পাওয়া গেছে। গতকাল মঙ্গলবার ও আগের দিন সোমবার ঘটে যাওয়া এসব ঘটনায় আহত হয়েছে অন্তত ৭০ জন।

আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:

খুলনা: খুলনার তেরখাদা উপজেলার শেখপুরা পশ্চিমপাড়া গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতকাল সকালে শেখপুরার পশ্চিমপাড়ায় আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া আশরাফ সরদার, কামরুল সরদারসহ কয়েকজনকে দেখে বিএনপির নেতা লাজুক, মুরাদ, মামুন ও বাদশা শেখ ধারালো অস্ত্র নিয়ে তাদের ওপর হামলা চালায়। এতে অন্তত ১৫ জন আহত হয়।
এর পরই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা পশ্চিমপাড়ায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের বাড়িতে হামলা চালায়। এতে অন্তত ১০ জন আহত হয়। আওয়ামী লীগের কর্মীরা পশ্চিমপাড়ার নুর ইসলাম, লুৎফর মেম্বার ও কাদেরের মুদি দোকান ভাঙচুর করে এবং মালামাল নিয়ে যায়। তেরখাদা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আব্দুল মান্নান বলেন, এ ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে।

মহেশখালী (কক্সবাজার): আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা দাবি করেন, মহেশখালী আসনে জামায়াতের প্রার্থী জয়ী হওয়ার পর রাতে তাদের ক্যাডাররা কালামারছড়া ইউনিয়নের মারাক্কাঘোনা বাজারে আওয়ামী লীগের কর্মী বেলাল হোসেন ও জহিরের চায়ের দোকানে হামলা ও ভাঙচুর চালায়। গতকাল সকালে আবার তারা মারাক্কাঘোনা এলাকার আবুল কালাম, সুলাইমান ও মাহবুবের বাড়িতে হামলা চালায়।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার পাশা চৌধুরী বলেন, জামায়াতের ক্যাডাররা দফায় দফায় তাঁদের নেতা-কর্মীদের দোকান ও বাড়িতে হামলা চালায়। তবে উপজেলা জামায়াতের আমির মোহাম্মদ জাকের হোসেন বলেন, এলাকায় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
মহেশখালী থানার ওসি মোহাম্মদ বেলাল উদ্দিন চৌধুরী বলেন, থানায় কোনো অভিযোগ আসেনি। অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাগেরহাট: মোরেলগঞ্জের তেলিগাঁতি ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক খান আবুল কালামের (৪৫) বাড়িতে গতকাল ভোরে সন্ত্রাসীরা ধারালো অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায়। এতে কালাম, তাঁর ভাই ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি রফিকুল ইসলাম খান, দুই মহিলাসহ ছয়জন আহত হন।
কালাম অভিযোগ করেন, জাতীয় নির্বাচনে চারদলীয় জোটের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের ক্যাডার আলী আজিমসহ ২০ থেকে ২৫ জন তাঁদের ওপর হামলা ও বাড়িতে লুটপাট চালায়। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ডা. মোজাম্মেল হোসেন অভিযোগ অস্বীকার করেন, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নিয়ে কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি। মোরেলগঞ্জ থানার এসআই দিবাকর চন্দ্র দাস বলেন, ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক যোগসুত্র আছে কি না তদন্ত করে দেখা হবে। গতকাল বিকেল পর্যন্ত এ ঘটনায় মামলা হয়নি।

সেনবাগ (নোয়াখালী): সোনাইমুড়ীর বারগাঁওয়ে গতকাল এক পক্ষের হামলায় বিএনপির কর্মীসহ নয়জন আহত হয়। বারগাঁও ইউনিয়ন বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক হেলাল (৪০) অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগের কর্মী মতিনের নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা তাঁর ওপর হামলা চালালে সংঘর্ষ বাধে। উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমিনুল ইসলাম বাকের বলেন, মতিন ও হেলালের ব্যক্তিগত বিরোধকে রাজনৈতিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। ওসি বাবুল চন্দ্র বণিকও বলেন, পূর্বশত্রুতার কারণেই এ ঘটনা ঘটেছে।

কুমিল্লা: বরুড়ার দক্ষিণ খোসবাস ইউনিয়নের মহেশপুর গ্রামের ভদ্রারপারে বিএনপির কর্মী জসিম ও আওয়ামী লীগের আনোয়ার হোসেনের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে মারামারি শুরু হয়। পরে এতে দুই দলের সমর্থকেরা জড়িয়ে পড়লে সংঘর্ষে অন্তত ১০ জন আহত হয়। থানার ওসি রণজিত কুমার পালিত বলেন, এ ঘটনায় এখনো কোনো মামলা হয়নি।

পাবনা: জেলার সুজানগর উপজেলায় মানিকহাট ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল হাইয়ের ওপর গতকাল সকালে সন্ত্রাসী হামলা হয়। তাঁকে পাবনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তবে কারা হামলা চালিয়েছে জানা যায়নি।
এদিকে উপজেলার উদয়পুর গ্রামে আওয়ামী লীগের কর্মীরা আবুল কালাম আজাদকে বাড়িতে ঢুকে মারধর করে। এই দৃশ্য দেখে আজাদের বড় ভাই আবু বকর অজ্ঞান হয়ে পড়েন। হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় থানায় বিকেল পর্যন্ত মামলা হয়নি। আজাদ এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী বলে থানার পুলিশ জানায়।

নড়াইল: জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সুবাস বোস অভিযোগ করেন, নড়াইল-১ আসনে জয়ী স্বতন্ত্র কবিরুল হক মুক্তির (আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্ককৃত) সমর্থকেরা তাঁর বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। মোবাইল ফোনে তাঁকে এই হুমকি দেওয়া হয়।

কালিয়া উপজেলা জাতীয় পার্টির মহিলা সম্পাদিকা শাহানাজ বেগম অভিযোগ করেন, নৌকার পক্ষে কাজ করায় নড়িয়া গ্রামের রিন্টু ও টিটো বাড়িতে গিয়ে তাঁকে লাঞ্ছিত করে। পেড়লী ইউনিয়নের শীতলবাটি গ্রামের আলাম শেখ (৪৫) ও ইসমাইল (৫০) ধানের শীষের পক্ষে কাজ করায় সন্ত্রাসীরা পেড়লী বাজারে তাঁদের লাঞ্ছিত করে।
কালিয়া থানার ওসি মেহেদী হাসান বলেন, জাতীয় পার্টির মহিলা সম্পাদিকার সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণকারীরা পলাতক। তবে হুমকির ব্যাপারে কোনো অভিযোগ পাননি।

রাজশাহী: বাঘা উপজেলার জোতজয়রাম গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক সন্তোষ অভিযোগ করেন, সোমবার রাত আটটার দিকে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর বিএনপির সমর্থকেরা সংখ্যালঘুদের কয়েকটি বাড়ি ও দোকানে হামলা ও ভাঙচুর করে। তবে উপজেলা বিএনপির সভাপতি জামাল উদ্দিন বলেন, তিনি এ রকম কোনো কথা শোনেননি। থানার ওসি খন্দকার গোলাম মোস্তফা বলেন, তিনি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের লিখিত অভিযোগ দিতে বলেছেন।

সাতকানিয়া (চট্টগ্রাম): সাতকানিয়ার উত্তর ঢেমশা বড়ুয়াপাড়ায় সোমবার রাতে সংখ্যালঘু লিটন বড়ুয়ার ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। একই রাতে পাশের পালিতপাড়ার মনোরঞ্জন পালিতের ধানের স্তুপে (মাড়াইয়ের জন্য রাখা) আগুন দেওয়া হয়। ওসি কাজী আবদুল ওয়াদুদ বলেন, ধান পোড়ানোর কথা পুলিশ জানলেও ঘর পোড়ার খবর পায়নি।

শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার): নৌকায় ভোট দেওয়ায় সন্ধ্যার পর শ্রীমঙ্গলে বিএনপির প্রার্র্থী মো. মুজিবুর রহমান চৌধুরীর হাজি মুজিব ফাউন্ডেশনের সদস্যরা রাজঘাট চা-বাগানে ১৭টি বাড়িতে হামলা চালিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে ১০ জন আহত হয়।

চা-বাগানের শ্রমিকেরা অভিযোগ করে, হাজি মুজিব ফাউন্ডেশনের স্থানীয় কমিটির প্রধান কানাই গোয়ালার নেতৃত্বে এই হামলা চালানো হয়। ওসি মো. সহিদ উল্লাহ বলেন, বাগানে বিডিআর মোতায়েন করা হয়েছে।

সরাইল (ব্রাহ্মণবাড়িয়া): লাঙলে ভোট দেওয়ায় আমিনীর (ধানের শীষের) সমর্থকেরা গতকাল সরাইলের ভুইশহর গ্রামে ১০ জনকে জখম করেছে। গ্রামবাসী ও পুলিশ জানায়, মাওলানা জয়নাল আবেদিনের নেতৃত্বে ২০ থেকে ২৫ জন গ্রামের কয়েকটি বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর চালায়। ওসি মো. আকলাছ হোসেন বলেন, বর্তমানে পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে।

প্রথম আলো, ৩১ ডিসেম্বর, ২০০৮

No comments:

Post a Comment