তৌফিক মারুফ বরিশাল
২০০১ সালের অক্টোবর মাসের কথা মনে পড়লে আজও আঁতকে ওঠে বরিশালের গৌরনদী ও আগৈলঝাড়া (বরিশাল-১) উপজেলার মানুষ। ওই বছর সংসদ নির্বাচনের পরের দিন ২ অক্টোবর থেকে তাদের ওপর শুরু হয় অমানবিক নির্যাতন। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর নির্যাতনের মাত্রাটা ছিল বেশি।
নৌকা মার্কায় ভোট দেওয়ার অভিযোগ তুলে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের স্থানীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকেরা এ নির্যাতন চালায়। সেই নির্যাতনের অন্যতম শিকার আগৈলঝাড়ার রাজিহার ইউনিয়নের বাহাদুর গ্রামের শেফালী রানী। গত বৃহস্পতিবার কথা হয় তাঁর সঙ্গে। নির্বাচনের প্রসঙ্গ উঠতেই দুই চোখ ছলছলিয়ে ওঠে তাঁর। কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, "গত ফিরে (গতবার) ভোডের পর হেরা মোরে কোপাইছে। ঘরবাড়ি ভাইঙ্গা দিছে। আবার ভোড আইছে। ভোডের কথা হুনলেই চোখের সামনে সব ভাইস্যা ওডে।"
২০০১ সালের নির্বাচনের পর নির্যাতনের শিকার গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ার সংখ্যালঘু পরিবারগুলোর অনেকে আশ্রয় নিয়েছিল গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার রামশীল গ্রামে। নির্যাতনের কথা গণমাধ্যমে প্রকাশের পর তৎকালীন জোট সরকার একে অপপ্রচার বলে চালানোর চেষ্টা করে। সে সময় কোটালীপাড়ায় ক্ষমতাসীন জোটের উদ্যোগে একটি সমাবেশও হয়। সমাবেশে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী উপস্িথত ছিলেন। গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ায় কোনো নির্যাতন হয়নি বলে সমাবেশ থেকে দাবি করা হয়। এই দাবির সপক্ষে বলার জন্য চার দলের লোকজন শেফালীকে সমাবেশে নিয়ে যায়। কিন্তু মঞ্চে উঠে শেফালী সমাবেশ আহ্বানকারীদের শেখানো কথা না বলে সরাসরি নির্যাতনের কথা তুলে ধরেন। শেফালীর সেই বর্ণনা সে সময় আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
হিন্দু অধ্যুষিত বাহাদুর গ্রামের লোকজন জানায়, এবারও তারা আতঙ্কে ভুগছে। ভয়ে অনেকে প্রকাশ্য কোনো প্রার্থীর পক্ষে প্রচারে নামার সাহস পাচ্ছে না।
গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ার হিন্দু অধ্যুষিত রাজিহার, ভালুকসী, সুতার বাড়ি, বাটরা, বারপাইকা, বাঘার, গৈলা, পতিহার, বাকাল, চাত্রিশিরা, আস্করসহ বেশ কিছু এলাকা ঘুরে ভোটারদের মধ্যে একই ধরনের শঙ্কা ও আতঙ্ক লক্ষ করা গেছে। পার্শ্ববর্তী উজিরপুরের হারতা, সাতলা, জল্লা এবং বানারীপাড়ার বিশারকান্দি, বাইশারী এলাকার ভোটাররাও আতঙ্কে আছে নির্বাচন নিয়ে।
চাত্রিশিরা এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বৃদ্ধা বলেন, "হারা সময় যেমন-তেমন, ভোডেরকালে আমাগো আত্মা ঘরে ওঠে। ঘরেরতন পা হালাইতেই পরান কাঁপে।"
গৌরনদীর বাটাজোড় বাজারের বঙ্কিম চন্দ্র বলেন, "গত ফিরের কথা মনে অইলে আর ভোডের মইদ্যে যাইতে মন চায় না। তয় এইবার ঠিক করছি কোনো মিছিল-মিটিংয়ে যামু না।"
গৌরনদী ও আগৈলঝাড়ার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোটাররা জানায়, প্রতিবার ভোটের পরেই এ দুই উপজেলার হিন্দু সম্প্রদায়ের অপেক্ষাকৃত দরিদ্র মানুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে গতবারের নির্যাতন ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। এবার তারা প্রকাশ্যে কোনো প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় নামার সাহস পাচ্ছে না।
এ আসনে গত নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন বিএনপির জহির উদ্দিন স্বপন। এবারও তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। তবে গত বৃহস্পতিবার তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন। এই আসনে এখন বিএনপি মনোনীত প্রার্থীআব্দুস সোবহান। নির্যাতন সম্পর্কে স্বপন বলেন, ওইবার নির্বাচনের পরে সংখ্যালঘুদের এলাকায় বিক্ষিপ্তভাবে কিছু সহিংস ঘটনা ঘটেছে। এবারও সে সব এলাকার ভোটারদের মধ্যে শঙ্কা দেখা গেছে। স্পর্শকাতর এসব এলাকায় এবার প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিশেষ সতর্কব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
এ আসনে এবার মহাজোটের প্রার্থী আওয়ামী লীগের তালুকদার ইউনুস। ভোটারদের আতঙ্কের ব্যাপারে তিনি বলেন, "আমি দল-মত নির্বিশেষ ভোটারদের উৎসাহিত করছি। আশা করছি, বিএনপি-জামায়াত জোটের নির্যাতনের আতঙ্ক ভুলে এবার তারা নতুন করে ঘুরে দাঁড়াবে।"
চার দলের প্রার্থী বিএনপির আব্দুস সোবহানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁর মন্তব্য জানা যায়নি।
পুলিশের বরিশাল রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক খান সাঈদ হাসান বলেন, স্পর্শকাতর এলাকাগুলোর তালিকা সংগ্রহ করা হয়েছে। ভোটারদের শঙ্কা দুর করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
প্রথম আলো, ২০ ডিসেম্বর, ২০০৮
No comments:
Post a Comment