ওরা কেন বারবার আশ্রয়হীন হবে?
সংখ্যালঘুদের বিড়ম্বনা
জয়নুল আবেদীন
সংখ্যালঘুদের বিড়ম্বনা
জয়নুল আবেদীন
সন্ত্রাসের জনপদ কালিয়াকৈর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলের পর প্রায় দু’বছর এ সরকারের আমলে শান্ত ছিল। কিন্তু সম্প্রতি জরুরি অবস্থার মধ্যেও হযরত আলীর নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী কালিয়াকৈর উপজেলার সাহেবাবাদ গ্রামসহ আশপাশের দু’তিন গ্রামের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর হিংস্র হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। ১০ সেপ্টেম্বর ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ইটিভির সচিত্র প্রতিবেদনে ধ্বংসলীলা প্রত্যক্ষ করলাম। শতাধিক পরিবারের ঘরবাড়ি ভেঙেচুরে-মারপিট করে অর্থসম্পদ লুটে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় শাসিয়ে যায় তিনদিনের মধ্যে দেশ ছেড়ে ভারতে না গেলে ‘কল্লা কেটে নেব’। সন্ত্রাসীদের হাতে তাদের পূজামণ্ডপগুলোও রেহাই পায়নি। সেখানে গৃহবধূ থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ পড়ূয়া মেয়েরা সন্ত্রাসীদের ভয়ে তটস্থ। ছাত্রীরা সস্ত্রাসীদের ভয়ে স্কুল-কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এ কোন মগের মুল্লুকে বাস করছি আমরা?
জরুরি অবস্থার মধ্যেই যখন এ অবস্থা, তখন জরুরি অবস্থা উঠে গেলে কী অবস্থা হবে তা সহজেই অনুমেয়। বাপ-দাদার চৌদ্দপুরুষের ভিটা ছেড়ে কেন তারা পরবাসী হবে? গৌরনদী-আগৈলঝাড়া এলাকায় জামায়াত-বিএনপি জোট সরকারের ক্যাডার বাহিনী ২০০১ সালে নির্বাচনী বিজয় উৎসব করতে গিয়ে নজিরবিহীন নারকীয় তাণ্ডব চালিয়েছিল। সেই জনপদে কিছুদিন আগে সন্ত্রাসীরা নারীর সম্ভ্রমহানির যে ঘটনা ঘটিয়েছিল, তা সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করতে ড. কামাল হোসেন, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নেত্রী ও সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল এবং কয়েকজন সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী গিয়েছিলেন। প্রশাসনের মধ্যে যাদের মামলা নিতে অনীহা ছিল, তারা বাধ্য হয়েছিল মামলা গ্রহণ করতে। মনীষী মাইকেল জোন্সের একটি বিখ্যাত উক্তি মনে পড়ল, ‘নির্বাচিত সরকার যখন স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে তখন তার চেয়ে ভয়াবহ আর কিছু হতে পারে না।’ দেশবাসী বিগত জোট সরকারের শাসনামলে ওই উক্তির সারবত্তা সঠিকভাবেই উপলব্ধি করেছে।
৩১ আগস্ট সমকালের শীর্ষ খবর ছিল ‘শীর্ষ সন্ত্রাসীরা দেশে আসা-যাওয়া করছে’। মনে হয়, নির্বাচনী হাওয়া বইতে শুরু করায় দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীরা খোঁজ-খবর নিতে আসে এবং তাদের বাহিনীর কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিয়ে আবার গোপন আস্তানায় ফিরে যায়। আসন্ন নির্বাচনে কিংবা নির্বাচনোত্তর সেই ভয়াবহ উল্লাস শুরু হয় কি-না এ শঙ্কা তাড়া করে। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্ত ও প্রায় তিন লাখ নারীর সম্ভ্রমহানির বিনিময়ে এবং অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের মাধ্যমে যে লাল-সবুজ পতাকার দেশটি পেলাম, সে দেশ তো সব মানুষের। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাই তো একসঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমরা যুদ্ধ করেছি। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ও ক্ষমতাবানদের এমন সর্বগ্রাসী উন্মত্ততা ২০০১ সালের নির্বাচনোত্তর নারকীয় নির্যাতনে প্রত্যক্ষ করলাম। সভ্য সমাজের সর্বজনীন স্বীকৃত মানদণ্ডগুলো, মানুষের জীবন ও সম্পদ এবং নারীর সম্ভ্রম-মর্যাদা-মানবাধিকার ও আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, রাজনৈতিক, ধর্মীয় নৃতাত্ত্বিক স্বাধীনতা কেন ভূলুণ্ঠিত হলো? রাউজানের অনাথ আশ্রমের শান্তির দূত বৌদ্ধভিক্ষু জ্ঞানজ্যোতি মহাথেরো ও মানিকছড়ির হিন্দু পুরোহিত মদন গোপাল গোস্বামীকে কারা হত্যা করেছিল? কেন আমাদের প্রিয় সহকর্মী সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদ নাজিরহাট কলেজের অধ্যক্ষ গোপাল কৃষ্ণ মুহুরীকে জামায়াত ক্যাডাররা হত্যা করল? এরা তো সবার নমস্য ও সব দলাদলির ঊর্ধ্বে। আমাদের আরেক শিক্ষক নেতা মাগুরার শালিখা উপজেলা শিক্ষক সমিতির সভাপতি মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক বিষ্ণুপদ রায়কে রাজনৈতিক ক্যাডাররা নৃশংসভাবে নির্যাতন করে দুই পা ও ডান হাত ভেঙে পঙ্গু করেছিল। তার অপরাধ- তিনি মিথ্যা কথা বলতে পারেননি। ক্যাডারদের জিজ্ঞাসার উত্তরে বলেছিলেন, লীগকে ভোট দিয়েছি।
উজিরপুর, গৌরনদী, আগৈলঝাড়ার স্কুলপড়ূয়া তের-চৌদ্দ বছরের ছাত্রীসহ অধিকাংশ গৃহবধূ গোপালগঞ্জের রামশিলে আশ্রয় নিল। তারপরও ওরা রক্ষা করতে পারেনি সম্ভ্রম। ভোলার ৮ বছরের মেয়ে রিনা পালিয়েও রক্ষা পায়নি। হার্ডিঞ্জের অর্ধবয়সী এক পা খোঁড়া শেফালী পালাতে না পারায় গণধর্ষণের শিকার হন। আগৈলঝাড়ার সম্মানিত ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য রেনুকা অধিকারীর আর্তচিৎকারে তার সর্বস্বহরণের কাহিনী বর্ণনা আর উল্লাপাড়ার দশম শ্রেণীর ছাত্রী সাহসিকা পূর্ণিমা ঢাকায় এসে সংবাদ সম্মেলন করে নররূপী পশুদের নির্যাতনের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা বাংলাদেশ তথা পৃথিবীর মানুষ জেনেছে। এক শিক্ষকের কন্যা ফাহিমা ধর্ষিত হওয়ার পর রাগে-দুঃখে-ক্ষোভে আত্মহত্যা করে প্রতিবাদের পথ বেছে নিয়েছে। এমনি করে মহিমা, ইন্দ্রানি ও সিমি একগুচ্ছ ফুটন্ত ফুল আত্মহনন করে প্রতিবাদের ভাষা বেছে নিল। এসবই আমাদের ইতিহাসের কলঙ্কিত অংশ।
গণতন্ত্রের মূলকথা পরমতসহিষ্ণুতা। কেউ কেউ গণতন্ত্রের নতুন সংজ্ঞা দিয়েছেন- ভয়শূন্য সমাজব্যবস্থা।
রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির’। শির উঁচু করে রাখতে পারাই গণতন্ত্র। নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের কথায়- ‘গণতন্ত্র ফিরে এলে দেশের উন্নতি হবে।’ আমরা কি ভয়শূন্য সমাজব্যবস্থার গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হতে পারি? যারা লালন করেছে সন্ত্রাসী এবং ২০০১ সালে যাদের ইঙ্গিতে বিজয়ের বীভৎস ও নিষ্ঠুর আনন্দে মেতে উঠেছিল তাদের ক্যাডার বাহিনী, রাজনীতির মঞ্চে তাদের উপস্থিতিতে কি গণতন্ত্র ফিরে আসবে? কালিয়াকৈরের হযরত আলী ও তার সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক। বাল্যবন্ধু ও মুক্তিযোদ্ধা অশোক, বিপ্রদাস, বিজয়সহ আরো অনেককে হারিয়েছি। আর যেন আমাদের বন্ধু, ভগ্নি, কন্যা, জায়া-জননীকে পরবাসী হতে না হয়। রাষ্ট্রে বসবাসকারী সব নাগরিকের অধিকার সমান। আইনের শাসন সবার জন্য সমভাবে চলুক।
লেখক : শিক্ষা গবেষক
সমকাল, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০০৯
No comments:
Post a Comment