অর্পিত সম্পত্তি যাচাই বাছাই ও নিষ্পত্তিকরণ অধ্যাদেশ ২০০৮ প্রসঙ্গে
মেজর সুধীর সাহা (অব:)
মেজর সুধীর সাহা (অব:)
ইতোমধ্যে বাংলাদেশের অনেকেই বুঝে গেছেন অর্পিত সম্পত্তি বলতে আইনে কী বলা হয়েছে। শুরুটা হয়েছিল শত্রু সম্পত্তি দিয়ে সেই পাকিস্তান আমলে। পরে সেটা রূপ নেয় অর্পিত সম্পত্তিতে। খোলসটা বদলে ফেলা হয় কিন্তু ভিতরের বস্তুটি একই থাকে। অর্পিত সম্পত্তি নামকরণ করে বাহ্যিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি ঘটে এটা ঠিক, কিন্তু মূল বিষয়টি একই থেকে যায়। মূল বিষয়টি এখানে কনসেপ্ট। যে কনসেপ্টে এই আইনটি গঠিত হয়েছিল সেই মূল বিষয়টিই ত্রুটিপূর্ণ ছিল। বাংলাদেশ থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের যেসব লোক ভারতে স্থায়ীভাবে চলে যাবে তাদের সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি বলে গন্য হবে। এবং সেই সম্পত্তির মালিকানা অর্পিত হবে বাংলাদে সরকারের ওপর। এখানে দু'টি বিষয়কে লক্ষ্য করেই সংশ্লিষ্ট আইন করা হয়েছিল। মূলত প্রথমে যে আইনটি করা হয়েছিল তার নামকরণ করা হয়েছিল শত্রু সম্পত্তি আইন। পাকিস্তান আমলে ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের ছিল একরকম বৈরী সম্পর্ক। এক দেশ আর এক দেশকে শত্রু গণ্য করত। তাই সেই কনসেপ্টে শত্রু দেশে যারা স্থায়ীভাবে বসবাস করবে তাদের সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে বাজেয়াফত করে মালিকানা সরকারের ওপর ন্যস্ত করার জন্য এক সময় শত্রু সম্পত্তি আইনের সূচনা ঘটেছিল। এর পর অনেক কিছু ঘটে গেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষ নিয়েছে এবং সর্বদিক দিয়ে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। তার সাহায্যের হাত ধরেই একদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়েছে। এর পর ভারতের সঙ্গে আর শত্রু সম্পর্ক নয় বরং বন্ধুসুলভ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ভারতকে বাংলাদেশ বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী এবং ভারতও বাংলাদেশকে বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশীই মনে করে। ফলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ছোটখাটো সমস্যা থাকলেও বৃহত্তর স্বার্থে দু'দেশের সঙ্গে ভাল সম্পর্কই বিদ্যমান। সম্পর্কের ধরন পরিবর্তন হওয়ায় এক সময় সংশ্লিষ্ট আইনটির নামকরণ পরিবর্তন করে অর্পিত সম্পত্তি রাখা হয়েছে। পরবর্তীতে উচ্চতর আদালতের নির্দেশে নতুন করে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে কোন হিন্দু সম্পত্তি তালিকাভুক্ত হতে বাধাগ্রস্ত হয়েছে, ফলে বর্তমানে কোন হিন্দু ভারতে চলে গেলেও তার সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি হিসাবে তালিকাভুক্ত হবে না। তারপরও কথিত অর্পিত সম্পত্তি আইনটি বলবত আছে আজও। নতুন করে হতে যাচ্ছে অর্পিত সম্পত্তি যাচাই-বাছাই ও নিষ্পত্তিকরণ অধ্যাদেশ ২০০৮। এখানে অর্পিত সম্পত্তি নিয়ে নতুন করে চিন্তাভাবনা হবে- কোনটা যাবে অর্পিত সম্পত্তির তালিকায়, কোনটা যাবে না, কেমন করে নিষ্পত্তি হবে তালিকাভুক্ত সম্পত্তি অথবা সরকারের করণীয় কী ইত্যাদি নতুন করে বিচার বিশ্লেষণ করে পদ্ধতি স্থির হবে এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে। অধ্যাদেশটির বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরার পূর্বে শত্রু বা অর্পিত সম্পত্তির কনসেপ্ট নিয়ে আলোকপাত করতে চাই। বাংলাদেশের হিন্দু নাগরিক যদি ভারতে স্থায়ীভাবে চলে যায় তবে তার রেখে যাওয়া সম্পত্তি শত্রু বা অর্পিত সম্পত্তি বলে গণ্য হবে এবং এই সম্পত্তির মালিকানা থেকে ঐ চলে যাওয়া নাগরিক বঞ্চিত হবে এবং ঐ সম্পত্তিতে সরকারের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হবে। একজন হিন্দু নাগরিক ভারত বাদ দিয়ে যদি অন্য কোন দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করে তাহলে সে ক্ষেত্রে কিন্তু তার সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে গণ্যহয় না। হিন্দু নাগরিকের জন্য ভারত শুধু এখানে বিবেচ্য বিষয়। কোন মুসলিম নাগরিক যদি ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাস করে তবে সে ক্ষেত্রেও কিন্তু এই আইনটি তার জন্য প্রযোজ্য হবে না, এই আইনটি করাই হয়েছিল শুধুমাত্র হিন্দু নাগরিককে লক্ষ্য করে। এক শ্রেণীর নাগরিকের জন্য গঠিত এমন একটি আইন সংবিধানসম্মত কিনা সে প্রশ্নের অবতারণা করার সুযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, কেবল এক শ্রেণীর নাগরিকের জন্যই আইনটি সীমাবদ্ধ নয়, বরং সেই এক শ্রেণীর নাগরিকের শুধু ভারত সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়েই তৈরি এই আইনটি আন্তর্জাতিক বিশ্বায়নের যুগে কতটুকু গ্রহণযোগ্য সে প্রশ্নও থেকে যায়। একটি দেশের বিশেষ একটি শ্রেণীর মানুষের জন্য, তাও সে আবার সংখ্যালঘু মানুষদের জন্য এবং একটি দেশকে কেন্দ্র করে এমনভাবে তৈরি করা একটি আইন শুধু আখ্যা পেতে পারে কালো আইন হিসাবে। তাই নতুন করে যাচাই-বাছাই নয় বরং আইনটি বাতিল করার অধ্যাদেশ নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহল ভাবতে পারে। সংবিধানে সকল নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করা হলেও শুধু অর্পিত সম্পত্তি আইন করে সংবিধানের এই সমঅধিকার নীতির পরিপন্থী কাজ করা হয়েছে সরাসরি। একজন হিন্দু আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইউরোপসহ অন্য সকল দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারে কিন্তু সে ক্ষেত্রে তাদের বাংলাদেশে রেখে যাওয়া সম্পত্তির মালিকানার ব্যাপারে কোন সমস্যা নেই। সমস্যা শুধু তারা যখন ভারতে যাবে। ভারত একমাত্র দেশ যেখানে কোন বাংলাদেশী হিন্দু নাগরিক স্থায়ীভাবে বসবাস করে তবে সে ক্ষেত্রেও তাদের রেখে যাওয়া সম্পত্তির মালিকানার ব্যাপারে কোন সমস্যা নেই। অর্পিত সম্পত্তি আইনের বিষয়বস্তু দুটি: হিন্দু নাগরিক এবং ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাস। এমন একটি আইন শুধু বিতর্কের জন্মই দেয় না বরং আইন প্রণেতাদের এক ধরণের পক্ষপাতিত্বের পরিচয়ই বহন করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অন্য সকল সম্প্রদায়ের লোকের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এদেশের হিন্দু নাগরিকগণও যুদ্ধ করেছিল। তাদের যুদ্ধের, তাদের ত্যাগের বিনিময়ে তারা যখন এমন একটি কালো আইন লাভ করে তখন তাদের স্বপ্নভঙ্গ হওয়ারই কথা। ভারতে কেন সংখ্যালঘুরা চলে যায়, কেন জন্মভূমির মায়া ছেড়ে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাস করে, কেন বাংলাদেশের সংখ্যালঘু জনগণ নিজ সম্পত্তি বিক্রি না করে ফেলে রেখে গোপনে দেশ ত্যাগ করে, তার কারণ না খুঁজে এবং তার প্রতিকার না করে বরং তাদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি সরকার কর্তৃক দখল করার আইন প্রণয়ন করে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনারই শুধু বরখেলাপ করিনি বরং মানবতা বিরোধী একটি কালো আইনের জন্ম দিয়েছি। শুধু সংখ্যালঘু জনগণের সম্পত্তি ভোগ করার লোভে কিছু সংখ্যাগুরু জনগণ তাদের দেশ ত্যাগে বাধ্য করে এবং এমনভাবে বাধ্য করে যে সংখ্যালঘু জনগণ নিজ সম্পত্তি বিক্রি পর্যন্ত করে যাওয়ার সুযোগ ও সময় পায় না। সরকার কর্তৃক তালিকাভুক্ত করা অর্পিত সম্পত্তি লিজ পেয়ে যায় প্রভাবশালী সংখ্যাগুরু জনগণের একাংশ। তাই এসব প্রভাবশালী মহল সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি লাভের আশায় কখনও কখনও তাদের বাধ্য করে দেশত্যাগের জন্য আর রাষ্ট্র অর্পিত সম্পত্তির আইন করে এদেশের প্রতিক্রিয়াশীল সম্পদ লোভী একদল সংখ্যাগুরু নাগরিককে সাহায্য করছে। পরিস্থিতি এমন একটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে, অনেক ক্ষেত্রেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নাগরিক ভারতে যাওয়ার জন্য নয় বরং এদেশে থেকেও নিজের প্রয়োজনে নিজের সম্পত্তি বিক্রি করার পরিবেশ পেতে বঞ্চিত হচ্ছে। ভারতে চলে যেতে পারে মনে করে কেউ তার সম্পত্তি ক্রয় করতে চায় না। কেননা একটা ধারণা কাজ করে যে বিক্রি না করতে পারলে ঐ সংখ্যালঘু নাগরিক তার সম্পত্তি ফেলে রেখেই ভারতে চলে যাবে। তখন তার সম্পত্তি সরকারের মাধ্যমে লিজ নিয়ে প্রায় বিনামূল্যেই লাভ করা যাবে। এমন অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে গ্রাম থেকে শহরে চলে আসার সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোক গ্রামের সম্পত্তি ফেলে রেখেই চলে এসেছে। কথিত অর্পিত সম্পত্তি আইন সুস্পষ্টভাবে এদেশের সংখ্যালঘু নাগরিকের স্বার্থবিরোধী একটি আইন। এমন আইন একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে থাকতে পারে না। আইনটি এতদিন লালিত-পালিত হয়েছে বলে আমাদের লজ্জিত হওয়া উচিত। সকল নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে অবিলম্বে এই কালো আইন বাতিল হওয়া উচিত। এ দেশের সকল মানুষের অধিকার সমান-এই শ্লোগান যদি বাস্তবায়িত করতে হয় তবে অর্পিত সম্পত্তি আইন বাতিল হওয়া উচিত। এ দেশের সকল মানুষের অধিকার সমান-এই শ্লোগান যদি বাস্তবায়িত করতে হয় তবে অর্পিত সম্পত্তি আইন বাতিল করতেই হবে। সকল মানুষকে স্বাধীনভাবে বসবাস করার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। কোন ব্যক্তি বাংলাদেশে না অন্য কোন দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করবে তা হবে শুধুই ঐ ব্যক্তির সিদ্ধান্ত। সে ক্ষেত্রে যেখানেই সে বসবাস করুক তার সম্পত্তি তারই থাকবে সরকার তা কোনভাবেই অর্পিত করে গ্রহণ করতে পারে না, কেননা বাংলাদেশ তার নিজ দেশ, জন্মস্থান। শুধু একটি নির্দিষ্ট দেশে চলে গেলই সেই জন্মের দেশটি তার জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যেতে পারে না; তার সম্পত্তি রাষ্ট্রের সম্পত্তি হয়ে যেতে পারে না। কেননা সম্পত্তি অর্জন যেহেতু নিজ ব্যক্তিগত আয় থেকে তাই তার সম্পত্তিতে শুধু তারই অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। আর যদি এমনটাই রাষ্ট্র করতে চায় তবে সে ক্ষেত্রে শুধু ভারত ও শুধু হিন্দু নাগরিকের জন্যই নয় বরং তা করতে হবে অন্যান্য দেশ ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের নাগরিকের জন্যও। এই বিবেচনায় অর্পিত সম্পত্তি যাচাই-বাছাই ও নিষ্পত্তিকরণ নয় বরং হওয়া উচিত অর্পিত সম্পত্তি বাতিল অধ্যাদেশ। এমন একটি কালো আইন বাতিল হলে তার সুফল শুধু সংখ্যালঘু নাগরিকই পাবে না বরং অর্পিত সম্পত্তি নিয়ে নানারকম জটিলতা থেকেও রাষ্ট্র রক্ষা পাবে। আর অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মহলও স্বস্তি পাবে এই দেখে যে বাংলাদেশ অন্তত দেরিতে হলেও এমন একটি বিতর্কিত কালো আইন বাতিল করে সকল মানুষের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছে। সংখ্যালঘু নাগরিকের প্রতি বৈষম্য দূর করতে এবং আইনের চোখে সকল নাগরিকের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে আমরা চাই সরকার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করুক। আমরা দেখতে চাই অর্পিত সম্পত্তি যাচাই-বাছাই ও নিষ্পত্তিকরণ অধ্যাদেশ ২০০৮ নয় বরং আমরা চাই অর্পিত সম্পত্তি বাতিল অধ্যাদেশ ২০০৮।
দৈনিক জনকষ্ঠ, ২৮ জুলাই, ২০০৮
No comments:
Post a Comment