নোয়াখালীর সন্ত্রাস কবলিত গ্রাম থেকে ফিরে - শেষ

বুধবার, ১৩ মার্চ ২০১৩, ২৯ ফাল্গুন ১৪১৯
নোয়াখালীর সন্ত্রাস কবলিত গ্রাম থেকে ফিরে শেষ ॥ হামলার সঙ্গে বরকত উল্লাহ বুলুর হাত থাকার অভিযোগ

আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা কথা বলছেন নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী
মহিউদ্দিন আহমেদ ॥ সাপ হয়ে দংশন করে ওঝা হয়ে ঝাড়ে। একই ঘটনায় একজন ব্যক্তির দ্বৈত চরিত্র বোঝাতে এ প্রবাদটি বহুল ব্যবহৃত হয়। নোয়াখালী রাজাগঞ্জের আলাদী গ্রামের সংখ্যালঘুদের ওপর জামায়াত-শিবির ও বিএনপি নেতাকর্মীদের ধ্বংসলীলা ও তাণ্ডব-পরবর্তী ঘটনায় এ চরিত্র ধরা পড়েছে। ২৮ তারিখ যারা নির্যাতন ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ করেছে সেই ব্যক্তিরাই পরের দিন সাধু সেজে নির্যাতিত পরিবারের খবর নিতে যান। স্থানীয় সাংসদ বরকত উল্লাহ বুলু এ চরিত্রের বাইরে ছিলেন না। তাঁর দলীয় নেতাকর্মীরা জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে ধ্বংসযজ্ঞে অংশ নেয়। আবার তিনি নির্যাতিত পরিবারকে ৫০ কেজি চাল দিয়ে করুণা দেখিয়েছেন। তবে ঘটনার পরেও ওই এলাকায় যাননি এ জনপ্রতিনিধি।

ঘটনার নির্মমতা এখনও তাড়া করে বেড়াচ্ছে সম্বলহারা নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের। তাদের সন্তানরা স্কুলে যায় না, ঘরে ফিরেনি বহু প্রাপ্তবয়স্ক কন্যা। দোকানপাট খোলা বা বাজারে যাওয়ার সাহস পাচ্ছেন না পুরুষরা। কারণ যেসব মানুষের সঙ্গে যুগের পর যুগ এক সঙ্গে বসবাস করছে সংখ্যালঘুরা সেই মানুষগুলো নির্মম নিষ্ঠুরভাবে তাদের বসতবাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার দৃশ্য নিজ চোখে অবলোকন করছেন। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা ও ক্ষতিপূরণ নিয়েও রাজনীতি করছে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতারা। ৯ মার্চ রাজাগঞ্জ বাজারের সন্ত্রাসকবলিত এলাকা ঘুরে ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলে এসব খবর জানা যায়।

যুদ্ধাপরাধের কারণে ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রায়কে কেন্দ্র করে ২৮ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালীর রাজাগঞ্জের আলাদী নগর গ্রামে সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মন্দির ভাংচুর এবং লুটপাট চালায় জামায়াত-শিবির ও বিএনপি নেতাকর্মীরা। সংখ্যালঘুদের ওপর তাণ্ডবলীলা যারা চালিয়েছে তাদের ৭০ ভাগই স্থানীয়। আইনজীবী সাইফুল ইসলাম হারুন, লিটন, মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন, বিপ্লব, সঞ্জয়ের সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। তাঁরা বলেন, ২৮ ফেব্রুয়ারি যারা তাণ্ডব চালিয়েছে তাদের বেশিরভাগ ব্যক্তিকে তাঁরা চেনেন। তবে ভয়ে কারও নাম প্রকাশ করেননি তাঁরা। নাম প্রকাশ না করলেও হামলা, অগ্নিসংযোগকারী ও লুটতরাজকারীদের অনেকে পরেরদিন থেকে সাধু সেজে তাদের সমবেদনা জানাতে বাড়িতে আসেন। যারা ঘরে আগুন দিয়েছে তাদের মধ্যে এমনও লোক ছিল যাদের সঙ্গে ঘটনার আগের দিন এক সঙ্গে বসে চা পান করা ও রাতে আড্ডা দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাণ্ডবের দিন তারা অতীত ভুলে নির্বিচারে আগুন জ্বালিয়ে বসতবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এমনকি সঞ্জয়কে হত্যা করতে ধাওয়া করেছে বলেও জানান তিনি। এ ঘটনার পর স্থানীয় সাংসদ বরকত উল্লাহ বুলু ক্ষতিগ্রস্তদের দেখতে না যাওয়ায় তারা এখনও নিজেদের নিরাপদ মনে করছে না। তাছাড়া ঘটনার অন্তরালে বুলুর হাত রয়েছে বলে অনেকে অভিযোগ করেন। কারণ হিসেবে তাঁরা মনে করেন, ওইদিনের ঘটনায় যে দুইজন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন তাঁরা দুজনই বিএনপির কর্মী। তাছাড়া স্থানীয় চেয়ারম্যান বিএনপির রাজনীতি করেন। যাকে ইতোমধ্যে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। বিরোধী দলের সাংসদ হিসেবে তিনি নির্যাতিতদের পাশে দাঁড়ালে হয়ত আক্রমণকারীরা কিছুটা হলেও ভয় পেত বলে উল্লেখ করেন তাঁরা। ঘটনাস্থলে না গিয়ে কিছু টাকা আর ৫০ কেজি ওজনের এক বস্তা চাল দেয়াকে নির্যাতিতরা সাপ হয়ে দংশন করে ওঝা হয়ে ঝাড়া বাক্যটির বাস্তবতা বলে মনে করেন। ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ৭২ জনের নাম উল্লেখ এবং আড়াই থেকে তিন হাজার ব্যক্তিকে অজ্ঞাত আসামি করে মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩১ জন গ্রেফতার করা হয়েছে। অপর আসামিরা নিজেদের রক্ষা করতে সংখ্যালঘুদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে বলেও অভিযোগ করেন নির্যাতিত পরিবারের সদস্যরা। এর কারণে ভয়ের পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে রাজাগঞ্জের সংখ্যালঘুদের। নয় মার্চ ঘটনাস্থলে গিয়ে কথা হয় মালি বাড়ির নকুল চন্দ্রের সঙ্গে। তিনি বলেন, তিনি ব্যবসা করেন কিন্তু ঘটনার পর তিনি বাজারে যেতে সাহস পান না। গত কয়েকদিন তাঁর দোকান বন্ধ রেখেছেন। তার মতো নির্যাতিত এলাকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্য পুরুষদেরও একই অবস্থা। তারা কাউকে এখন আর বিশ্বাস করতে পারেন না। কখন কোন গুজব তুলে তাদের ওপর জামায়াত-শিবির তাদের দোসরদের নিয়ে হামলে পড়ে সে বিষয়ে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন তাঁরা। রাতে ঘুম হয় না রাজাগঞ্জের হিন্দুদের। নিরাপদহীন ঘরে স্ত্রী, সন্তানদের রেখে চাকরিতে যাওয়ার সাহস পায় না তারা। কার্তিক চন্দ্র দাস মাইজদীতে একটি বেসরকারী হাসপাতালে চাকরি করেন। ঘটনার পর তিনি বাড়িতে এসে স্বজনদের সঙ্গে দুঃখ ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন। তিনি প্রতিবেদককে বলেন, ভয়ে রাতে ঘুমাতে পারি না। বাড়ির সব পুরুষ রাত জেগে স্ত্রী সন্তানও স্বজনদের পাহারা দিয়ে সময় পার করেন।

শ্রাবন্তী, প্রীতি রানী। দুই শিশু পড়ে স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সজীব পড়ে অষ্টম শ্রেণীতে। ঘটনার দিন তাদের স্কুলের বই পুড়ে যায়। তাছাড়া শিশু বয়সে যে তাণ্ডব তারা দেখেছে সে ভয় তাদের তাড়া করে বেড়ায়। যাতে তারা স্কুলে যাওয়ার সাহস পায় না। তবে অভিভাবক ও স্কুল শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফেরানোর চেষ্টা করছেন বলে জানান, বাকিপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আবু নাসের বলেন, যাদের বই পোড়া গেছে তাদের নতুন করে বই দেয়ার কাজ তাঁরা শুরু করেছেন। ইতোমধ্যে কয়েকজনকে বই দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। একই সঙ্গে ভয় কাটিয়ে শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফেরানের চেষ্টা করছেন তাঁরা।

সম্ভ্রম হারানোর ভয়ে বাড়ি ফিরছে না প্রাপ্তবয়স্কা কন্যারা। এক বান্ডিল করে টিন দিয়ে বসতভিটা ঘেরাও করে হিন্দু পরিবারগুলোকে বাড়িতে আনা হয়েছে। কিন্তু এমন পরিবেশে নারী ও কন্যাদের থাকা নিরাপদ মনে করছেন না ঘরহারা সংখ্যালঘুরা। মাঝে মধ্যে পুলিশ ঘটনাস্থলে এলেও স্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প ছাড়া নিজেদের নিরাপদ মনে করছেন তাঁরা। তাই এখনও অনেক পরিবারের প্রাপ্তবয়স্কা কন্যাদের তারা স্বজনদের বাড়িতে রেখেছেন। গত দুই সপ্তাহ উপাসনালয়ে যেতে পারছেন না হিন্দুরা। তাঁরা বলেন, তাদের গ্রামে ৬টি মন্দির ছিল। সব মন্দিরই ভাংচুর করা হয়েছে। মূর্তি ভাংচুর করতেও দ্বিধা করেনি জামায়াত-শিবির ও বিএনপি।

তবে ঘটনার পর আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা ঘটনাটিকে নিয়ে রাজনীতি করছে বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়। ভয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন বলেন, ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণে সঠিকভাবে করছে না স্থানীয় নেতারা। তারা নিজেদের মতো করে ক্ষতির পরিমাণ এবং ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করছেন। তাছাড়া তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল রাখতে তাদের নিরাপদহীন ঘরে রাখতে বাধ্য করছে। তাঁরা বলেন, এখানে নির্যাতিতদের প্রকৃত কথাটি বলার সুযোগ দেয়া হচ্ছে না। নাগরিক সমাজ, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি এবং গণমাধ্যম কর্মীসহ বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থার প্রতিনিধিরা ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গেলে স্থানীয়, আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা নিজ নিজ সুবিধা অনুযায়ী কথা বলেন। এ সময় তারা ব্যক্তিগত সুবিধার দিক বিবেচনা করে কথা বলেন বলে অভিযোগ করেন নির্যাতিতরা।

শ্যামলী রানী, শিশুবালা, মণিকা রানী দাস, কার্তিক চন্দ্ররা দাবি করেন, তাদের ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে সঠিক তালিকার মাধ্যমে তাদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার। এক বান্ডিল টিন, বা ৫০ কেজি চাল এ ধরনের করুণা তাঁরা চান না। দেশের নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের ক্ষতিপূরণ দাবি করেন তারা।

দৈনিক জনকণ্ঠ। লিংক

No comments:

Post a Comment