নির্বাচনোত্তর নির্যাতিত ২০ হাজার মানুষ আশ্রয় নেয় রামশীলে

মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ (৯)
তপন বিশ্বাস॥ ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার রামশীল গ্রাম হয়ে উঠেছিল পার্শ্বববর্তী এলাকার নির্যাতিতদের আশ্রয়স্থল। গ্রামবাসীর তত্ত্বাবধানে সেখানে খোলা হয়েছিল লঙ্গরখানা। নিরাপত্তা বিধানে গঠন করা হয় ২১ সদস্যের কমিটি। নির্যাতিত, ধর্ষিতদের সান্তনা দিয়ে রক্ষা করা হয় আত্মহত্যার হাত থেকে। প্রশাসনের দায়সারা আশ্বাসে বিশ্বাস করে এলাকায় ফেরেনি নির্যাতিতরা। এ সম্পর্কিত কিছু ঘটনা তুলে ধরা হলো ধারাবাহিকের এই পর্বে।

গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া থানার রামশীল একটি দুর্গম ও প্রত্যনত্ম গ্রাম। কোটালীপাড়া থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১৫ কিঃ মিঃ। রামশীল এলাকায় শতকরা প্রায় ৯৫ ভাগ হিন্দু সম্প্রদায়ের বাস। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর নির্বাচনের পরদিন থেকেই রামশীলের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল পার্শবর্তী থানা/এলাকা থেকে নির্যাতিত সংখ্যালঘুরা। এলাকাটি হিন্দু অধ্যুষিত হওয়ায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এই এলাকাকে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বেছে নেয়। নিজ এলাকার ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হওয়ায় শত শত নারী-পুরুষ ও শিশুদের মধ্যে যাদের নির্যাতন করা হয় তাদের কয়েকজন বরিশালের আগৈলঝাড়ার রাজিহাঁড়ি ইউনিয়নের তৎকালীন সদস্য কমলা রানী রায়, শেফালী রানী সরকার, বাবুলাল মুন্সী, হরিহর রায়, রিয়াজ মোহন রায়, মহেন্দ্রনাথ রায়, বাসুদেব রায়, দেবুরাজ রায়, শান্তিরঞ্জন রায়, বিজয় কৃষ্ণ রায়, শচিন্দ্রনাথ রায় প্রমুখ। এখানে আরও আশ্রয় নিয়েছিল গৌরনদী থানার উত্তর চাঁদসী, কাপালী, অশোক কাঠী ও আগৈলঝড়ার কোদালদহ গ্রামের সহস্রাধিক পরিবারের মানুষ। এই রামশীলে আশ্রয় নিয়েছিল উজিরপুর থানা এলাকার নির্যাতিত পরিবারের সদস্যরাও।

কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাগেরহাটের মোল্লারহাট থানার জয়ঘা, চাঁদেরহাট, মাদারতলি, বুড়িগাংনি, বড়গাওলা, চাঘদা গ্রামের নির্যাতনের শিকার সংখ্যালঘু পরিবারের অনেক সদস্য রামশীলে এসে আশ্রয় নিয়েছিল বলে স্থানীয় সূত্রে জানা যায়। আশ্রয় নিয়েছিল স্থানীয় স্কুল, কলেজ ও বিভিন্ন বাড়িতে। রামশীল কলেজ ভবন ও সামনের মাঠ পরিণত হয়েছিল এক আশ্রয় শিবিরে। সংখ্যালঘু ও আওয়ামী লীগ সমর্থকরা আশ্রয় নিয়েছিল এই আশ্রয় শিবিরে। আশ্রয় নিয়েছিল গৌরনদী, আগৈলঝাড়া, উজিরপুর, বাগেরহাট থেকে পালিয়ে আসা ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী সমর্থকরা। রামশীলে আশ্রয় নেয়া আশ্রিতদের অনেকেই চরম দুঃখ কষ্টের মধ্যে দিনাতিপাত করতে হয়েছে। নির্যাতিতদের অনেকেই প্রাণ ভয়ে বাড়িঘর ছেড়ে আসার সময় প্রয়োজনীয় অর্থ-কাপড়চোপড় সঙ্গে আনতে পারেনি। আশ্রিতদের মধ্যে খাবারের অভাব ছিল প্রকট। গ্রামবাসী তাদের সাধ্যানুযায়ী খাবার রান্না করে দিয়েছে, সকলে তা ভাগ করে খেয়ে জীবন বাঁচিয়েছে। প্রায়দিন অনেককে আধাবেলা উপোস করতে হয়েছে। আশ্রিতদের সঙ্গে আশ্রয়দাতাও খাবার ভাগাভাগি করে খেয়েছে। নির্যাতিতদের চিকিৎসাসেবা ছিল না বললেই চলে। সরকারী-বেসরকারী সাহায্যও তারা পায়নি। তদন্ত কমিশন তাদের কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে বহুল আলোচিত এই রামশীল পরিদর্শন করে। পরিদর্শন কালে তারা স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান বিমল বিশ্বাস, কার্তিক চন্দ্র বাড়ৈ, মেম্বার রামশীল, নিত্যলাল বালা, ডগলাস স্কুলের প্রধান শিক্ষক, স্থানীয় মন্দির সেবায়েত নবীন চন্দ্র রায়, মৃণাল কান্তি হালদার, ইউপি চেয়ারম্যান অসীম বিশ্বাস, প্রাক্তন ইউপি চেয়ারম্যান সচিন্দ্র নাথ, রামশীল কলেজের অধ্যক্ষ, প্রফেসর জয়দেব বালাসহ স্থানীয় বিভিন্ন স্তরের লোকজনের সঙ্গে মতবিনিময় করে।

মতবিনিময়কালে বিশ্বদেব রায় জানান, তার বাড়িতে প্রায় ৩০ জনের মতো আশ্রয় নিয়েছিল। তিনি তাঁর দোতলা ঘরটি আশ্রিতদের জন্য ছেড়ে দেন এবং সাধ্যমতো খাবার সরবরাহ করেন। নিহার রঞ্জন বাড়ৈ জানান, নির্বাচনের পরদিন হতেই আগৈলঝাড়া এলাকা থেকে নির্যাতিত লোকজন আসতে শুরু করে। ৪ অক্টোবর ঘরবাড়ি ছাড়া নির্যাতিত মানুষের ঢল আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যায়। তার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল রাজেন্দ্র চন্দ্র, রাজিহার ইউনিয়নের কমলা দেবীসহ অনেকে। তিনি কমিশনের নিকট কমলা দেবীর বাড়িতে লুটপাট ও নির্যাতনের লোমহর্ষক কাহিনী তুলে ধরেন।

প্রাক্তন মেম্বার কার্তিক চন্দ্র রায় সচিন্দ্রসহ কয়েকজন মিলে আশ্রিতদের থাকা, খাওয়া ও নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভাল করেন। এজন্য তখন গঠন করা হয় ২১ সদস্যের একটি কমিটি। গ্রামবাসীর সহায়তায় একটি লঙ্গরখানা খোলা হয়। মন্দির সেবায়েত নবীন চন্দ্র রায় জানান, গৌরনদী, আগৈলঝাড়া, উজিরপুর, বাগেরহাটের মোল্লাহাট এলাকা থেকে হিন্দু, মুসলমান, নির্বিশেষে হাজার হাজার নির্যাতিত মানুষ এই রামশীলে আশ্রয় নেয়। আশ্রিতদের মধ্যে অনেক মা-বোনই ধর্ষিত হয়ে এসেছে বলে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন। এলাকার সকলে মিলে তাঁদের সাধ্যমতো সাহায্য করেছেন। আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবে রামশীলের আশ্রয় গ্রহণকারীদের সাহায্য করে। একপর্যায়ে প্রায় প্রতিদিন ১৫/১৬ মণ করে চাল খরচ হয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সে সময় ব্যক্তিগতভাবে টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করেন। এলাকাবাসীর ধারণা সব মিলিয়ে প্রায় ১৮ থেকে ২০ হাজার লোক আশ্রয় নিয়েছিল এই রামশীলে।

আশোক বৈদ্য কমিশনের সামনে এসে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করেন এভবে- "আমি ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি তবে শুনেছি পাকহানাদের নির্যাতনের কাহিনী। '৭১-এর নির্যাতন না দেখলেও জোট সরকারের সন্ত্রাসীদের ১ অক্টোবরের নির্বাচনপরবর্তী সহিংসতা দেখেছি। এ নির্যাতন যেন '৭১-এর নির্যাতনকেও অনেক ক্ষেত্রে হার মানিয়েছে। রামশীলে অনেক মা-বোনকে দেখেছি নির্যাতনের পর, অনেক শিশু খেতে পায়নি ঠিকমতো। আমাদের বাড়িতে প্রায় দুই শ' আহত ব্যক্তিকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। অনেক ধর্ষিত মা-বোন আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। আমরা তাদের বুঝিয়ে নিবৃত করেছি। নির্যাতিত মানুষের অসহায় মুখ ও বোবা কান্নার রোল যেন আজও রামশীলের আকাশে-বাতাসে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।"
স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে রামশীলে আশ্রয় গ্রহণকারীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিজ নিজ এলকায় ফিরে যাওয়ার জন্য চাপ দেয়া হয়েছিল। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী রামশীল আশ্রয়কেন্দ্র পরির্দশনের কথা ছিল বলে এলাকাবাসী জানায়। কিন্তু তিনি যাননি। ২০০১ সালের ১২ অক্টোবর তৎকালীন গোপালগঞ্জের ডিসি, বরিশালের ডিসি, এসপি আসেন রামশীলের আশ্রিতদের খোঁজখবর নিতে। তাঁরা আশ্রিতদের নিজ গ্রামে ফিরে যেতে বলেন। কিন্তু অবস্থা এতটাই ভয়াবহ ছিল যে কেউই বাড়ি ফিরে যেতে রাজি হয়নি। কারণ এর মধ্যে যাঁরা বাড়ি যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল তাঁরা পথিমধ্যে কেউবা মার খেয়েছেন, কেউবা সন্ত্রাসীদের তাড়া খেয়ে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসেছে। তাই কর্তাব্যক্তিদের আশ্বাসের পরও তারা কেউ বাড়ি ফিরে যেতে রাজি হয়নি।

সূত্র: দৈনিক জনকণ্ঠ, ২০ জুন, ২০১১

No comments:

Post a Comment