কৃষকের আত্মহত্যায় নেত্রকোনার গ্রামে চলছে মাতম

সঞ্জয় সরকার, মোহনগঞ্জ, নেত্রকোনা থেকে ফিরে।। নেত্র কোনার মোহনগঞ্জের বড়তলি-বানিহারি ইউনিয়নের ছোট হাতনি গ্রামে চলছে শোকের মাতম। কান্নাররোল যেন আর থামছে না। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি গৌরাঙ্গ সরকারের আত্মহননের ঘটনায় শোকে পাতর হয়ে গেছেন গ্রামটির সকল মানুষ। মর্মান্তিক ঘটনাটি কোনভাবেই মেনে নিতে পারছেন না তারা। গৌরাঙ্গর পরিবার ও গ্রামবাসী বলছেন, প্রভাবশালীদের সঙ্গে লড়ে গ্রামবাসীর ভূসম্পত্তির অধিকার ক্ষা করতে না পারার ক্ষোভ-যন্ত্রণাতেই আত্মাহুতি দিয়েছেন এই প্রতিবাদী কৃষক। এদিকে প্রথমে অপমৃত্যুর মামলা নিলেও এখন ঘটনার মূল রহস্য অনুসন্ধানে নেমেছে পুলিশ। জোর করে গ্রামবাসীর ধান কেটে নেয়ার অভিযোগে শুক্রবার রাতে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে মোহনগঞ্জ থানায়। নীরদ চন্দ্র দেবনাথের দায়ের করা মামলাটিতে উপজেলা বিএনপির সভাপতি আ ক ম শফিকুল হকের ভাই কলেজ শিক্ষক রফিকুল হক ও পাঁচ ব্যক্তির নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও ১৫/২০ জনকে আসামি করা হয়। ওই দিন রাতেই পুলিশ মৌলা মিয়া নামে এক আসামিকে গ্রেফতার করে। এদিকে কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থাও ঘটনার খোঁজখবর নিতে শুরু করেছে। সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, বাপ-দাদার আমল থেকে কৌড়াতলা হাওড়ের ৬ একর জমি ভোগদখল করে আসছিলেন ছোট হাতনি গ্রামের শতাধিক সংখ্যালঘু পরিবার। ১৯৮৯ সালে গ্রামের চার ব্যক্তি গোপাল সরকার, নীরদ দেবনাথ, খগেন্দ্র দত্ত ও উপেন্দ্র সরকারের নামে জমিটি বন্দোবস্তও নেন তারা। কিন্তু গত জোট সরকারের আমলে ( ২০০৫) ক্রয় সূত্রে ওই জমির মালিকানা দাবি করেন উপজেলা বিএনপি সভাপতির ভাই মোহনগঞ্জ ডিগ্রী কলেজের শিক্ষক রফিকুল হক। তিনি দাবি করেন, এলাকার ছদ্দু মিয়ার ছেলে টিটু মিয়ার কাছ থেকে ওই জমির তিন একর কিনে নিয়েছেন তিনি। এ নিয়ে দু'পক্ষের মধ্যে চলতে থাকে মামলা-মোকদ্দমা। জমির দখলস্বত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে গ্রামবাসীর ওপর হামলাও হয় একাধিকবার। অনিল ঘোষ (৪৮) জানান, প্রায় দেড় বছর আগে রফিকের লোকজনের হামলায় একটি পা হারান তিনি। সে মামলা এখনও বিচারাধীন আছে আদালতে। গ্রামবাসী জানান রফিক গং বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে হামলা, নির্যাতন ছাড়াও চাঁদাবাজির অভিযোগসহ ৩টি মিথ্যা মামলা দিয়ে নিরীহ কয়েক ব্যক্তিকে জেলজুলুম পর্যন্ত খাটায়। এদের কয়েকজন হচ্ছেন: বিকাশ দেবনাথ, জ্যোতিষ দেবনাথ, সুশেন দেবনাথ, গোপাল চন্দ্র কর, সন্তোষ কর, অনিল কর, সতীশ কর। গোপাল সরকার, সন্তোষ সরকারসহ অন্যরা বলেন, রফিক ও তার লোকজনের অত্রাচার, নির্যাতন থেকে বাঁচাতে গ্রামবাসীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন স্থানীয় কৃষকলীগ নেতা গৌরাঙ্গ সরকার। তিনিই এসব মামলা-মোকদ্দমা পরিচালনা করতেন এবং গ্রামের নেতৃত্ব দিতেন। বিপদে-আপদে তিনিই ছিলেন তাদের আশ্রয়। এসব কারণে বিভিন্ন হুমকি ধমকি ও চাপের মুখে থাকতে হতো তাকে।

{জোর করে ধান কাটা মামলায় বিএনপি নেতার ভাই আসামি}

গ্রামবাসীর অভিযোগ, প্রায় ২০ দিন আগে তারা যখন নিজেদের আবাদ করা বোরো ধান কাটার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, ঠিক তখনই জোর করে সব ধান কেটে নিয়ে যায় রফিকেরে লোকজন। বাধা দিতে গেলে বিভিন্ন হুমকি ধমকি দেয়া হয় তাদের। এ সময় বিভিন্ন স্থানে ধর্ণা দিয়েও প্রতিকার পাননি তারা। জোর করে ধান কেটে নেয়া, মামলা-মোকদ্দমার হয়রানি এবং দফায় দফায় হুমকি ধমকির কারণে এক পর্যায়ে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন গৌরাঙ্গ সরকার। প্রভাবশালীদের সঙ্গে টিকেতে না পারা এবং গ্রামবাসীর সঙ্গে টিকতে না পারা এবং গ্রামবাসীর ভূসম্পত্তির অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে না পারার ক্ষোভ যন্ত্রণাতেই শেষ পর্যন্ত আত্মহননের পথ বেছে নেন সবার প্রিয় গৌরাঙ্গ বাবু।

এদিকে ধান কেটে নেয়ার অভিযোগে মামলা করার পর থেকে আত্মগোপনে আছেন রফিকুল হক। অজ্ঞাত স্থান থেকে তিনি মোবাইলে জানান, ক্রয়সূত্রে তিনি জমিটির মালিক। ২০০৭ সালে আদালত থেকে ডিক্রিও পেয়েছেন তিনি। তবে গ্রামবাসী জানান, তারা এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতে আপীল করেছেন। জোর করে ধান কেটে নেয়া ও গ্রামবাসীর ওপর হামলার সকল অভিযোগ অস্বীকার করে রফিকুল হক বলেন, গৌরাঙ্গর নামে এ জমির কোন দখলসত্ত্ব বা বন্দোবস্ত নেই।

গৌরাঙ্গর আত্মহননের পর থেকে শোকে পাথর হয়ে গেছে তার গোটা পরিবার। মা নেই। বাবাকে হারিয়ে নির্বাক হয়ে পড়েছেন গৌরাঙ্গর দুই ছেলে দিলীপ ও জীবন সরকার। তার ৬ মেয়ের মধ্যে বিয়ে হয়েছে মাত্র দুই মেয়ের। গৌরাঙ্গর মৃত্যুতে রীতিমতো নিঃস্ব হয়ে গেছে পরিবারটি। তাদের বুকচাপা কান্না থাকাতে গিয়ে কাঁদছেন গোটা গ্রামবাসীই। গৌরাঙ্গর বড় মেয়ে জনতা সরকার জনকণ্ঠকে বলেন, গ্রামের মানুষের জমি সম্পত্তি রক্ষা করতে না পারার ক্ষোভেই আত্মহত্যা করেছেন আমার বাবা। গৌরাঙ্গর পরিবারসহ গ্রামবাসীর দাবি এখন একটাই, যে জুলুম, অত্যাচার নির্যাতনের জন্য আত্মহত্যা করেছেন গৌরাঙ্গ, সেই দখলদার ও জুলুমবাজদের যেন সুষ্ঠু বিচার হয়। আর যেন কোন গৌরাঙ্গকে হারাতে না হয় এভাবে।

দৈনিক জনকণ্ঠ, ৭ জুন ২০০৯

No comments:

Post a Comment