নির্বাচনোত্তর অত্যাচারের কথা ভোলেনি সংখ্যালঘু মানুষ

সামছুজ্জামান শাহীন ও কাজী আবদুল্লা, খুলনা

২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনের পর খুলনা এলাকায় যতগুলো প্রতিহিংসামূলক ঘটনা ঘটেছিল, তার অধিকাংশেরই শিকার হয়েছিল ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। এদের বাড়িতে, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুট ও নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। প্রশাসন ছিল নির্বিকার। সামাজিক বা রাজনৈতিক কোনো আশ্রয়ও পায়নি তারা। অনেকে দেশ ছেড়ে যেতেও বাধ্য হয়েছিল। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর তাদের কেউ কেউ আপন ঘরে ফিরে এসেছে। কিন্তু তাদের চোখেমুখে এখনো আতঙ্কের ছাপ। ভয়ে কেউ মুখ খুলতে চায় না।
২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চারদলীয় জোটের বিজয় ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রূপসা উপজেলার ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অধ্যুষিত ঘাটভোগ ইউনিয়নে বিজয়ীদের সমর্থকেরা এসব তান্ডব চালায়। নির্বাচনের রাত থেকে প্রায় এক মাস ধরে চলে এ তান্ডব।
নির্বাচনের ২০ দিন পর রূপসা উপজেলার ঘাটভোগ ইউনিয়নে মন্টু রানার বাড়ি ভাঙচুর হয়। মন্টুর স্ত্রী গৃহবধু পুতুল রানীর (৩৬) ভাষায়, ‘যেদিন জিতিল সেদিন স্লোগান দিয়ে ওরা কইলো অমুকের মাথা নেব, অমুকরে দেইহে নেব। তাই নির্বাচনের রাতি জীবন বাঁচাতি বাপের বাড়ি গিয়ে উঠিলাম। ২০ দিন পর বাড়ি ফিরলিও ওরা রাতি আইসে আমাগে মাইরে ফেলতি হামলা করিলো। ভগবানের ইচ্ছেয় গ্রামের মানুষ আগোইয়ে আসায় বাঁইচে আছি।’
ঘাটভোগের সিন্দুরডাঙ্গা জনকল্যাণ সংঘ নামে একটি ক্লাবের সদস্যদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে মারধরসহ অস্ত্র ঠেকিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। এরপর অনেকেই গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে ছিল অনেক দিন।
ক্লাবের সদস্য অজিত চক্রবর্তী বলেন, ‘ক্লাবঘরটির অপরাধ ছিল, এ ঘরে বসে আমরা কয়েকজন আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছি। এবার আর কোনো প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার ইচ্ছে নেই। ভোট দেওয়ার পরিবেশ হলেও ভোটটা দেব কি না, ভেবে দেখব।’
৭২ বছর বয়সী কার্তিক বিশ্বাস বলেন, ‘২০০১ সালের নির্বাচনের পর সিন্দুরডাঙ্গা গ্রামের ৫০টি পরিবার বিজয়ী দলের নেতা-কর্মীদের প্রতিহিংসার শিকার হয়েছিল। ওই সময়ের কথা মনে হলে এখনো আঁতকে উঠি। অনেক দিন গ্রামের মানুষ রাত জেগে পাহারা দিয়ে জীবন বাঁচিয়েছি।’
জানা গেছে, প্রতিহিংসার হাত থেকে বাঁচতে রূপসা উপজেলর আনন্দনগর গ্রামের তাহিদ মোল্লা গ্রাম থেকে চলে যান। তাঁর মতো ঘাটভোগের রতন শিকদার, নিপুণ মুখার্জি, তরুণ দাশ, নিখিল চন্দ্র পালও গ্রামছাড়া হন। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার পর তাঁরা গ্রামে ফিরেছেন। আনন্দনগর গ্রামের বাসিন্দা সাবেক সেনাসদস্য গাউস লস্করের বাড়িতে ভাঙচুরসহ লুটপাটের ঘটনা ঘটে। থানায় মামলা দিতে গেলে পুলিশ মামলা নেয়নি। একইভাবে রূপসা টিএস বাহিরদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয়ে বিএনপির নেতা-কর্মীরা ঢুকে ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবুর রহমানকে লাঞ্ছিত করে।
দিঘলিয়া উপজেলার একটি গ্রামের স্কুলপড়ুয়া এক মেয়েকে অস্ত্রের মুখে তুলে নিয়ে পার্শ্ববর্তী একটি ইটভাটায় নির্যাতন চালানো হয়। মেয়েটি এখন কলেজছাত্রী। ওই ঘটনার পর তার এক ভাই এখনো গ্রামছাড়া। অপর দুই ভাই তিন বছর পালিয়ে থেকে গ্রামে ফিরেছে।
মেয়েটির মা বলেন, ‘মাইয়েডারে বিয়ে দেওয়ার জন্যি চেষ্টা কইরেও কাজ হচ্ছি নে। দুইবার পাত্র ঠিক অলিও ঘটনা শুইনে পাত্রপক্ষ বিয়েতে রাজি হয়নি।’
জেলার দিঘলিয়া উপজেলার প্রায় ১০০ পরিবার নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গাজীরহাট ইউনিয়নের মানুষ। ওই ইউনিয়নের মাঝিরগাতি গ্রামের নারিকেল ব্যবসায়ী সুজিত বিশ্বাস বলেন, ‘নির্বাচনের তিন দিনের মাথায় ২৫ কাঠার চিংড়িঘেরটি স্থানীয় বিএনপির নেতারা দখল করে নেয়। পুলিশকে জানিয়ে কোনো লাভ হয়নি। পরে জীবন বাঁচাতে এলাকা ছেড়ে দীর্ঘদিন অন্যত্র থেকেছি।’ একই গ্রামের হরিদাশ কুমার বিশ্বাস, আব্দুল হাকিম মোল্লা, ডোমরা গ্রামের মনিমোহন বিশ্বাস, সুধীর কুমার বিশ্বাস, পদ্মবিলা গ্রামের লুৎফর রহমান, জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘নির্বাচনের পর আমাদের চিংড়ি মাছের ঘেরগুলো লুট করে নেওয়া হয়।’
তেরখাদা উপজেলার মধুপুরের বাসিন্দা মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘নির্বাচনের পর স্থানীয় বিএনপির নেতাদের হুমকির মুখে গ্রাম ছেড়েছি। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসার পর গ্রামে ফিরেছি।’
গাজীরহাটের ইউনিয়নের মহিষদিয়া গ্রামের বাসিন্দা সাবেক ইউপি সদস্য শেখ জাহাঙ্গীর হোসেনের বাড়িতে স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীরা হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। এর পর থেকে ওই বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র থাকে জাহাঙ্গীরের পরিবার। ভাঙচুরের চিহ্ন এখনো রয়ে গেছে। জাহাঙ্গীরের স্ত্রী রহিমা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগে ভোট দেওয়ার অপরাধে এ হামলা হয়। আমরা এখনো আতঙ্কে আছি।’
ভোট-পরবর্তী নির্যাতন হয়েছিল চরমপন্থী অধ্যুষিত খুলনা-৫ (ডুমুরিয়া-ফুলতলা) আসনের অনেক গ্রামে। শোভনা, মাগুরখালী, রংপুর, সাহস, মাগুরাঘোনা, গুটুদিয়া, ভান্ডারপাড়া, ধামালিয়া, রঘুনাথপুর, রুদাঘরা, খর্নিয়া, শরাফপুর ও আটলিয়াসহ হিন্দু অধ্যুষিত এলাকার মানুষ ভয়ে এখনো মুখ খুলতে চায় না। বাগিছাড়া এলাকার অনেক মানুষ এখনো ঘরে ফেরেনি।
শুধু শোভনা গ্রাম থেকে ৫০০ মানুষকে ঘরছাড়া করা হয়। হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, পাশবিক অত্যাচার−সবই চলে সেখানে। তার পরও পুলিশ উল্টো মামলায় ফাঁসিয়ে শত শত মানুষকে হয়রানি করেছে।
সাত হাজারের বেশি মানুষকে অসংখ্য মামলার বোঝা নিয়ে বছরের পর বছর জেল খাটতে হয়েছে। ডুমুরিয়ার বড় চিংড়িঘেরগুলো দুর্বৃত্তরা দখল করে নিয়েছে।
শোভনা গ্রামের আশিস কুন্ডু, স্কুলশিক্ষক মনোতোষ নন্দী, তারক মুখার্জি, বসন্ত মল্লিক, জিয়েলতলা গ্রামের ঠাকুর মন্ডল, বাগছড়া গ্রামের দেবাশীষ ঢালী, বাদুরগাছা গ্রামের বিজন সরদার ও সুমন মন্ডল, চন্ডীপুর গ্রামের দিবদাস মন্ডল, লাঙ্গলমোড়া গ্রামের অসিত ঠিকাদার, পূর্ব পাতিবুনিয়া গ্রামের পরিমল রায়, কাঁঠালিয়া গ্রামের উজ্জ্বল মল্লিক সন্ত্রাসীদের অত্যাচারে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন। ইতিমধ্যে দেশে ফিরেছেন শোভনার গোবিন্দ মল্লিক, সুশান্ত মল্লিক, রতন মল্লিক, নিমাই দাস, সমর মল্লিক, পলাশ বসাক, অরুণ দাস, কার্তিক মল্লিক, প্রভাত মল্লিক।
ডুমুরিয়া আসনের সাবেক সাংসদ জামায়াতের নেতা মিয়া গোলাম পরওয়ার প্রথম আলোর প্রশ্নের জবাবে বলেন, ২০০১ সালে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে ওই উপজেলায় কোনো নির্যাতন হয়নি। এটি অপপ্রচার। তবে শোভনাসহ কিছু গ্রামে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে পুলিশ কিছু নিরীহ মানুষকে হয়রানি করেছে। কিন্তু জোট সরকার সে সময়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, চরমপন্থীদের অত্যাচার থেকে এলাকাকে মুক্ত করার জন্য ওই অভিযান প্রয়োজন ছিল। তিনি চরমপন্থীদের সহায়তায় নির্বাচিত হয়েছিলেন বলে যে অভিযোগ করা হয়, তা অপপ্রচার বলে মন্তব্য করেন।
জামায়াতের নেতা অভিযোগ করেন, তাঁকে ভোট না দেওয়ার জন্য নতুন করে বিভিন্ন এলাকায় বাড়িতে বাড়িতে ভয় দেখানো হচ্ছে।
ডুমুরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ নুরুদ্দীন আল মাসুদ বলেন, বিদেশ থেকে ফিরে সন্ত্রাসীদের সংগঠিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। আর যারা এলাকায় আছে তারা বিচ্ছিন্ন। তবে তারা প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে।
উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক খান আলী মনসুর বলেন, সন্ত্রাসী এখনো যারা বাইরে আছে, তাদের দেশে আসার সম্ভাবনা আছে। ফিরলে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। ক্ষমতা দেখাতে পারে।
পুলিশের উপমহাপরিদর্শক মো. আসাদুজ্জামান মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ভীতির কোনো কারণ নেই। গোয়েন্দাসহ সব ধরনের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সার্বক্ষণিক সামাজিক-রাজনৈতিক যোগাযোগ রাখতে বলা হয়েছে। কোনো সন্ত্রাসী হুমকি দিতে পারবে না। কোনো অবস্থাতেই আগের কোনো সহিংস ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেওয়া হবে না।
র‌্যাব-৬-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মেফতাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, কিছু এলাকায় হুমকি দেওয়ার কথা তাঁরাও জেনেছেন। তবে এ বিষয়ে র‌্যাব পূর্বসতর্কতামূলক সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে। যাতে ঘটনা ঘটার আগেই ব্যবস্থা বা পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়। এ সপ্তাহেই স্পর্শকাতর এলাকাগুলোতে র‌্যাব পূর্ণ শক্তি নিয়ে মাঠে নামছে বলে জানান তিনি।

প্রথম আলো, ১৫ ডিসেম্বর, ২০০৮

No comments:

Post a Comment