প্রাণে বাঁচতে পুকুরে ডুব দিয়েছিলেন তিনি, মেরে ফেলা হল পিটিয়ে

 উজ্জ্বল বিশ্বাস, বাঁশখালী
জামায়াত-শিবির ক্যাডারদের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় বাঁশখালীর জলদী ধোপাপাড়া। বাসিন্দারা খোলা আকাশের নিচে দিন কাটাচ্ছেন। ছবি : কালের কণ্ঠ
জামায়াত-শিবির ক্যাডারদের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় বাঁশখালীর জলদী ধোপাপাড়া। বাসিন্দারা খোলা আকাশের নিচে দিন কাটাচ্ছেন। ছবি : কালের কণ্ঠ
'হাতের শাঁখা ভেঙে ফেল, না হয় ধর্ষণ করব' জামায়াত-শিবির ক্যাডারদের এমন হুমকির মুখে বাঁশখালী পৌরসভার জলদী গ্রামের ধোপাপাড়ার এক গৃহবধূ তার হাতে থাকা শাঁখাও ভেঙে ফেললেন। তবু নিস্তার পাননি। তার মতো আরো কয়েকজন গৃহবধূর ওপর নির্যাতন চালিয়ে ক্ষান্ত হয়নি ওরা। আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় একে একে সাতটি বসতঘর ও আশ্রম। এই দৃশ্য দেখে ওই পাড়ায় শীলকূপ থেকে বেড়াতে আসা দয়ালহরি (৬০) প্রথমে টয়লেটে আত্মগোপন করেন। এক পর্যায়ে পাশের পুকুরে ডুব দিয়ে বাঁচার চেষ্টাও চালান। রেহাই মিলল না। পুকুর থেকে উঠিয়ে উপর্যুপরি লাঠির আঘাতে পিটিয়ে মেরে ফেলা হল তাকে।
বৃহস্পতিবার সাঈদীর ফাঁসির রায় ঘোষণার পর বাঁশখালীতে জামায়াত-শিবির ক্যাডারদের তাণ্ডবের এতটুকুন বর্ণনা দিয়েই কান্নায় ভেঙে পড়লেন ধোপাপাড়ার বাসিন্দারা। আর কথা বলার শক্তি পেলেন না। ধোপাপাড়ার মতো উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় নারকীয় তাণ্ডব চালায় কয়েক হাজার ক্যাডার। বৃহস্পতিবার বিকেলে ও শুক্রবার ভোরে সশস্ত্র হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগে উপজেলা সদর এখন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। প্রশাসনের ৪২ বছরের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র ও স্থাপনা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আদালতের ৮ হাজার মামলার নথিপত্রের স্মৃতিচিহ্নও নেই।
হামলাকারীরা উপজেলা সদরের ধোপাপাড়ার সাত বসতঘর, অদ্বৈতানন্দ আশ্রম, লোকনাথ আশ্রম ও ১৮টি দোকানঘর পুড়িয়ে দেয়। নাপোড়া জলদাসপাড়া কালিবাড়িসহ চার শতাধিক দোকানঘরে লুটপাট ও ভাঙচূর করা হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়িসহ শতাধিক গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয় এবং থানা পুলিশের দুটি গাড়িসহ অর্ধশতাধিক গাড়ি ভাঙচুর হয়। ঘটনার পর থেকে বাঁশখালীজুড়ে আতংক বিরাজ করছে। ভয়-আতংকে অধিকাংশ জায়গায় দোকানপাট বন্ধ রয়েছে।
হামলায় নিহত দয়ালহরি শীলের মেয়ে সবিতা সুশীল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বাবাকে সন্ত্রাসীরা লাঠি দিয়ে আঘাত করতে করতে মেরে ফেলেছে। হত্যার পর তারা উল্লাস করছিল। আমরা আতংকে রয়েছি। ঘরে আগুন লাগিয়ে সবকিছু পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।'
উপজেলা সদর জলদী, বৈলছড়ি, গুনাগরি, চেচুরিয়া, শীলকূপ, বাহারছড়া, নাপোড়া, প্রেমবাজার, রামদাস মুন্সির হাট এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মায়ের আশীর্বাদ ট্রেডার্সের মালিক বাবুন দাশ, নুপুর দাশ, মো. আশরাফ আলী, মৃদুল দত্ত, অশোক দাশ, পরীক্ষিত দেসহ প্রত্যক্ষদর্শী ব্যবসায়ীরা বললেন, 'সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হামলা খুবই জঘন্যতম ছিল। তারা দোকানের লাখ লাখ টাকার মালামাল লুট করে এবং চলে যাওয়ার সময় অগ্নিসংযোগ করে।'
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার হাফিজ আক্তার বলেন, 'সবকিছু সুকৌশলে দেখা হচ্ছে। আমরা তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রকৃত দোষীদের একটা একটা করে খুঁজে বের করবই।'
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাবি্বর ইকবাল বলেন, 'বাঁশখালীতে যেভাবে তাণ্ডব চালানো হয়েছে তা অতীতের সব ইতিহাসকে হার মানিয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির তালিকা করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।'
গতকাল সকালে সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, সরকারি স্থাপনাগুলোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বইয়ের গুদামে আগুন দেওয়ায় কয়েক হাজার বই পুড়ে গেছে। মামলার নথিপত্র পুড়ে যাওয়ায় ফৌজদারি ও দেওয়ানি আদালতের ৮ হাজার মামলার অনেক বাদী-বিবাদী আদালত চত্বরে আর্তনাদ করছেন, কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে বাঁশখালী সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ও সহকারী জজ আদালত, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিস, সদর থানা ও রামদাস পুলিশ ফাঁড়ি, উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান অফিস, কৃষি অফিস, প্রকৌশলী অফিস, প্রকল্প অফিস, শিক্ষা অফিস, যুব উন্নয়ন অফিস ও পৌরসভা কার্যালয়সহ অন্তত ৪৭টি সরকারি অফিসে। এসব অফিসে দরজা, জানালা ও আসবাবপত্রের অস্তিত্বও নেই। দোকানে দোকানে হামলা চালিয়ে দুই শতাধিক বৈদ্যুতিক মিটার ভেঙে ফেলা হয়েছে।


কালের কণ্ঠ

No comments:

Post a Comment