ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হতো নন্দিতাকে সিলেটে তোলপাড়

সিলেটে ধর্মান্তরিত ডা. নন্দিতা স্বামীর দ্বারা বন্দিদশা থেকে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে মুক্তি চাইছেন
সিলেটে স্বামীর দ্বারা বন্দি ধর্মান্তরিত ডা. নন্দিতা
শনিবার, ১০ নভেম্বর ২০১২

ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে: ডা. জামিকে ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন নন্দিতা। ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। বিয়ের পর পরিচিতি পান ডা. নন্দিতা আহমদ নামে। দুই সন্তানের জননী তিনি। কিন্তু কপালে সুখ সইলো না তার। স্বামী ডা. জামির নির্মম নির্যাতনে শেষমেশ তার জীবনের অন্ধকার নামিয়ে আনলো। জামি তাকে জোরপূর্বক ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখতো
। কখনও তার ওপর চালাতো অমানুষিক নির্যাতন। কয়েক মাস ধরে বন্দি রেখে জামি ডা. নন্দিতাকে নির্যাতন করে আসছিল। আর দৃশ্য দেখে কিশোর ছেলে প্রতিবাদ জানালে তাকেও ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়। জামির নির্যাতনের এই ঘটনাটি প্রকাশ পেয়েছে গতকাল বিকালে। নন্দিতার ভাই মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ এলাকার বিজন বিহারী সিনহা এসে বোন নন্দিতাকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে নিয়ে যান। ঘটনা প্রকাশের পরপরই সিলেটে তোলপাড় শুরু হয়েছে। ডা. জামির পুরো নাম ডা, জুলফিকার আহমদ জামি। সিলেট নগরীর মীরের ময়দানের অর্ণব ৭৭নং নাবিল ভিলার বাসিন্দা তিনি। আর ডা, নন্দিতা সিনহার বাড়ি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জে। তার পিতা মৃত বিকীন বিহারী সিনহা। জামি বর্তমানে হজ পালনে সৌদি আরবে রয়েছেন। যাওয়ার আগে তিনি নন্দিতাকে তালাবদ্ধ করে রেখে যান। এক মাস ধরে ঘরে তালাবদ্ধ নন্দিতা। জানা গেছে, ১৯৮৬ সালে নন্দিতা বিয়ে করেন সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ জুলফিকার আহমেদকে। নন্দিতা সিলেটের জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক। গতকাল নন্দিতার ভাই বিজিত সিনহা সিলেট কোতোয়ালি থানায় লিখিত অভিযোগ করেন যে, তার বোনকে নিজ বাড়িতেই বন্দি করে রেখে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে রাখা হয়েছে। যে কোন সময় তিনি মারা যেতে পারেন। এ অভিযোগ পেয়ে বিকালে সিলেট কোতোয়ালি থানার এসআই শাহ মো. মুবাশ্বিরের নেতৃত্বে একদল পুলিশ কেওয়াপাড়ায় ওই বাসায় গেলে তালাবদ্ধ ফটকে নিয়োজিত পাহারাদার বাধা দেয়। এ সময় দোতলা থেকে নন্দিতা নিজের পরিচয় দিয়ে তার বন্দি থাকার বিষয়টি পুলিশকে অবহিত করেন। তাকে অনবরত ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে রাখা হয়েছে বলে চিৎকার করে বাবার বাড়ি যাওয়ার আকুতি প্রকাশ করেন। পুলিশ তখন চিকিৎসক জুলফিকারের আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ করে। আত্মীয়রা এ ব্যাপারে কোন সহায়তা করতে রাজি না হলে পুলিশ সিলেটে সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর আবদুল খালিককে খবর দিয়ে ঘটনাস্থলে নিয়ে যায়। শেষে কাউন্সিলরের মধ্যস্থতায় বিকাল সাড়ে ৪টায় নন্দিতাকে ঘরের তালা খুলে মুক্ত করা হয়। দোতলা বাসা থেকে নিচে নেমে এসেই তিনি বিজিতসহ তার আরও দুই ভাইকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। প্রায় দুই মাস ধরে তার ওপর চলা মানসিক নির্যাতন করার কারণ হিসেবে তিনি অভিযোগ করেন- তার স্বামী সম্প্রতি দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। এ বিয়ের প্রতিবাদ জানানোয় তাকে গত প্রায় ৬ মাস ধরে মানসিক নির্যাতন করা হচ্ছে। সর্বশেষ স্বামীর সঙ্গে হজে যেতে বাধ্য করার চেষ্টা করেন। তিনি স্বামীকে একা হজে যেতে বলেন এবং ওই সময় নিজে বাবার বাড়ি যাওয়ার কথা বলতেই তাকে এভাবে ঘরে বন্দি করে রাখা হয়। মুক্ত হওয়ার পর ডা. নন্দিতা সাংবাদিকদের বলেন, বাসার মূল ফটক ও সিঁড়ির ফটকে দুটো তালা দিয়ে শয়নঘরের দরোজায়ও আরেকটি তালা মেরে রাখা ছিল। খাবার দেয়ার সময় ফটকে নিয়োজিত দুজন পাহারাদার সঙ্গে নিয়ে তার স্বামীর আত্মীয়রা কেবল ঘরে প্রবেশ করতো। গত এক সপ্তাহ আগে তিনি জানালা দিয়ে প্রতিবেশী একজনকে তার ভাইয়ের নাম ও ঠিকানা দিলে গতকাল তার তিন ভাই পুুলিশ নিয়ে এ বাসায় আসেন। নন্দিতা বলেন, ‘আমি একজন চিকিৎসক। আমার স্বামী আমাকে পরিকল্পিতভাবে মানসিক রোগী বানানোর চেষ্টা করছেন। অযথা ঘুমের ওষুধ খাইয়ে আমাকে এক ধরনের ঘোরের মধ্যে রাখা হয়েছিল। নন্দিতার ভাই বিজিত সিনহা সাংবাদিকদের জানান, স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করার পরই নন্দিতার ওপর এ ধরনের নির্যাতন শুরু হয়। সর্বশেষ নিজ ঘরে বন্দি থাকায় তারা বাধ্য হয়ে পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। এদিকে, গতকাল বিকালে উদ্ধারের সময় পুলিশ ও নন্দিতার বাবারবাড়ির লোকজনদের একরকম জিম্মি করে রাখেন জামির আত্মীয়রা। ডা. জামির ভগ্নিপতি জাকির সাংবাদিকদের বলেন, নন্দিতা ধর্মান্তরিত। আইনত তার বাবারবাড়ির লোকজন অভিভাবক নন। এ অবস্থায় স্বামীর অনুপস্থিতিতে আমরা নন্দিতাকে দিতে পারি না। এ সময় ওয়ার্ড কাউন্সিলর কোন অঘটন ঘটলে দায়-দায়িত্ব নিতে হবে- এ কথা বলে শেষে লিখিত অঙ্গীকারের মাধ্যমে হস্তান্তরে সম্মত হন। এ ব্যাপারে ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবদুল খালিক মানবজিমনকে বলেন, ডা. জামির দ্বিতীয় বিয়ে কেন্দ্র করেই স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দ্বের সৃষ্টি বলে মনে করা হচ্ছে। জামি নন্দিতাকে প্রায়ই ঘুমের ওষুধ খাইয়ে নির্যাতন করে বলে জানান তিনি। হজে যাওয়ার আগে এভাবে স্ত্রীকে বাসায় বন্দি করে যাওয়াটা আসলেই একটি অমানবিক ঘটনা বলে উল্লেখ করেন তিনি। কাউন্সিলর খালিক জানান, নন্দিতার ছোটো মেয়েকে তার দাদীর কাছে এবং বড় ছেলেকে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে। এ ব্যাপারে এসআই মুবাশ্বির সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ঘটনাস্থলে গিয়ে তার সত্যতা পাওয়ায় পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ধার করেছে। এ ব্যাপারে গতকালই থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে।

মানবজমিন। ১০/১১/১২। লিঙ্ক

No comments:

Post a Comment