হবিগঞ্জে ঋষিদের শারীরিক, যৌন নির্যাতনের অভিযোগ

সম্ভ্রম ও ভিটেবাড়ি রক্ষার আকুতি নির্যাতিতদের

রফিকুল হাসান চৌধুরী তুহিন, হবিগঞ্জ থেকে ॥ হবিগঞ্জের সদর উপজেলাধীন নূরপুর ইউনিয়নের সুতাং বাজারে বসবাসরত সংখ্যালঘু ঋষি সম্প্রদায়ের লোকজনের ওপর মধ্যযুগীয় কায়দায় শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন চলানোর এক লোমহর্ষক কাহিনীর জন্ম দিয়েছে একশ্রেণীর সন্ত্রাসী ও মাদক বিক্রেতা। শুধু তাই নয়, হামলা-ভাংচুরসহ নানাবিধ ভীতি সঞ্চার করে ওদের এখন ভিটেবাড়ি থেকেও উচ্ছেদের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে চক্রটি। আর এ চক্রের নেতৃত্বে রয়েছে একই এলাকার আনছব আলীর পুত্র শিপন মিয়া ও নূরপুর ইউপির সদস্য রাবেয়া বেগমের পুত্র সুজন।

শনিবার সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, ওই এলাকার সুতাং ব্রিজের পূর্ব ও পশ্চিম পাড়ে বংশানুক্রমিকভাবে প্রায় ৪৪ শতক ভূমির ওপর বসবাস করছে ৪টি ঋষি পরিবার। তন্মধ্যে একটি বাড়ির ভূমির পরিমাণ ৪ শতক। আর এ পরিমাণ ভূমি থেকে পরিবারগুলোকে উচ্ছেদ করে তা দখলে নেয়াই মূলত ওই চক্রের মূল উদ্দেশ্য। এরই অংশ হিসেবে সম্প্রতি রাত ৩ টায় বাসন্তী রবিদাসের বাড়িতে হানা দেয় চক্রটি। এ সময় বাসন্তী রবিদাসসহ তার পরিবারের অন্য সদস্যরা ঘুমুচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে সন্ত্রাসী চক্রটি ঘরের দরজা ফাঁক করে ভেতরে প্রবেশ করে। সন্ত্রাসীরা পরে ঘুমন্ত লোকজনকে মারধর ও লাথি মেরে ফেলে দেয় মাটিতে। শুধু তাই নয়, সন্ত্রাসী চক্রের মূল হোতা শিপন ও সুজন বাসন্তী দাসের মুখে কাপড় চাপা দিয়ে তুলে নিয়ে যায় অন্যত্র। তারপর অজ্ঞাত স্থানে আমার মুখে ও হাতে চেপে ধরে.....(অবশিষ্ট কথাগুলো লজ্জায় বলতে পারছিল না)। পরে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। এভাবে বাসন্তীকে আরও একদিন উঠিয়ে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা স্থানীয় এক ডাক্তার বাড়ির নিচে। তাতেও ওরা ক্ষান্ত হয়নি। বাসন্তী জানায়, ওরা তার বোবা বোনকে একই রকম বেইজ্জতি করেছে। এমন ঘটনা আবারও হতে পারে তা জেনে বোবা বোনটিকে পাঠিয়ে দেই ননদের বাড়ি।

বাসন্তী জানান, এ সন্ত্রাসী চক্রের হাতে ৭ বছর আগে তার স্বামী অর্জুন রবি দাস ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারান। এভাবেই চোখে মুখে এক রকম ভয় ও উৎকণ্ঠার ছাপ নিয়ে বাসন্তী জানাচ্ছিলেন এখনও একের পর এক তারসহ ঋষি পরিবারগুলোর সদস্যদের ওপর নানারকম নির্মম নির্যাতনের বহু কাহিনী। এমনকি ঋষি পরিবারের সদস্যদের মাদক বেচাকেনায় জড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে এসব সন্ত্রাসী। এ সময় ছুটে আসলেন সদর উপজেলাধীন ৯ নং নূরপুর ইউপির ৪ নং ওয়ার্ডের সদস্য মোঃ আবু বক্কর সিদ্দিকী। তিনি জানান, ওইসব চক্রের সদস্যরা অত্র এলাকার সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং বড় মাদকসেবী ও বিক্রেতা। ওদের বিরুদ্ধে আমাদের কিছু করার সাহস নেই। তিনি আরও জানান, কয়েক বছর আগে অপর একটি ঋষি পরিবারের কর্তা রবি দাস মারা গেছেন। বলতে গেলে তারপর থেকেই চারটি ঋষি পরিবার এখন পুরুষশূন্য। আর একমাত্র পুরুষ সদস্য হিসেবে এখন যিনি কোনরকম দাঁড়িয়ে আছেন রামলাল রবিদাস (২৪)। ৫ দিন আগে এ রামলালও সন্ত্রাসীচক্রের হামলায় গুরুতর আহত হন। তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালে ছিলেন। ৩ দিন পরে তিনি বাড়ি ফেরেন। তাকে জিজ্ঞেস করলে জানান, ওই দিন রাতে আমি বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম। পথিমধ্যে সন্ত্রাসী চক্রের কয়েকজন মিলে আমাকে চেপে ধরে এবং ছুরি দিয়ে দেহের কয়েক স্থানে পোঁচ দেয়। এ সময় রামলাল তার গলায় ও পেটে ছরিকাঘাতের চিহ্ন দেখান। তিনি এ সময় আক্ষেপ করে বলেন, আমি এ ঘটনা শিপনের বড় ভাইকে অবহিত করেছিলাম। তখন তিনি আমাকে পাল্টা বলেন, তোমরা তোমাদের জায়গার কিছু অংশ আমাকে দিয়ে দাও। তাহলে তোমাদের আর সমস্যা হবে না। একই সময় উপস্থিত ৩নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আব্দুস সাত্তার জানান, আমি ঋষি পরিবারের একটি জায়গা ভাড়া নিয়ে দোকান দিয়েছি। আমি এখানে থাকায় ওরা এখনও টিকতে পেরেছে। নয়ত অনেক আগেই ঋষি পরিবারগুলো উচ্ছেদ হয়ে যেত। তিনি আরও জানান, এসব পরিবারের ওপর যখন বেশি অত্যাচার হয়, তখন আমাকে ওরা স্মরণ করে। ফলে সন্ত্রাসীদের ধরে পুলিশেও সোর্পদ করেছি। কিন্তু কয়েকদিন পরেই বেরিয়ে আসে সন্ত্রাসীরা। যে কারণে সন্ত্রাসীরা আমার ওপরও হামলা করেছে। এদিকে এ সময় ঘটনাস্থলে আসা ৭নং নূরপুর ইউনিয়নের বার বার নির্বাচিত জনপ্রিয় চেয়ারম্যান গোলাম কিবরিয়া চৌধুরী বেলাল জানান, ঋষি পরিবারগুলোর ওইসব অভিযোগ সত্য। আমি নিজে পরিষদের মেম্বারদের নিয়ে সন্ত্রাসী চক্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছি। এমনকি পুলিশেও সোপর্দ করেছি। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে বেরিয়ে আসে ওরা। এমতাবস্থায় ঋষি পরিবারগুলোর একটি মাত্র আকুতি, আমরা প্রাণে বাঁচতে চাই। সন্ত্রাসী-মাদক ব্যবসায়ীদের হাত থেকে মান-সম্মান-সম্ভ্রম আর ভিটে বাড়ি উচ্ছেদ আতঙ্ক থেকে রক্ষা করুন। নইলে আত্মহত্যা করা ছাড়া আমাদের কোন পথ খোলা থাকবে না।
এদিকে শায়েস্তাগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজিজুর রহমান সরকার ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেছেন, তিনি ৩ বার শিপনকে ধরেছেন। এমনকি জনতা কর্তৃক ধৃত সুজনকে আমাদের হাতে দিলে গত ১৭ মে জামিনে বেরিয়ে আসে। তিনি বলেন, এলাকার সকল মানুষ ওদের বিরুদ্ধে। আমরা শতভাগ নিরাপত্তা দিতে প্রস্তুত। অভিযোগ পেলে এ সন্ত্রাসী চক্রের বিরুদ্ধে আবারও এ্যাকশনে যাব। তবে অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে ওই সন্ত্রাসীদের পেছনে ক্ষমতাধর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সহযো সম্ভ্রম ও ভিটেবাড়ি রক্ষার আকুতি নির্যাতিতদেরগিতা ও প্রভাবশালী কয়েক ব্যক্তির হাত রয়েছে। ফলে অনেক সময় পুলিশও নানা অজুহাতে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না। এদিকে ওই দিন পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট হবিগঞ্জ জেলা শাখার আহ্বায়ক কবি ও সাহিত্যিক তাহমিনা বেগম গিনির নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থলে যায়। তারা অত্যাচারিত ঋষি পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলেন। তারা এমন নির্যাতনের হোতাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় প্রশাসনসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতি আহ্বান জানান। সেই সঙ্গে ঋষি পরিবারগুলোর নিরাপত্তা প্রদানেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সরকারের প্রতি জোর দাবি জানিয়েছেন।

দৈনিক জনকণ্ঠ

No comments:

Post a Comment