তেজেন্দ্রলাল শীলের ভিটে এখনও শূন্য: বাঁশখালীর সেই ১১ হত্যাকাণ্ড

হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥
বিগত চারদলীয় জোট সরকার আমলে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর সাধনপুর শীলপাড়ায় পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের শিকার সেই তেজেন্দ্রলাল শীলের পরিবারটির কথা মনে পড়ে কি। পরিকল্পিতভাবে ঘরে অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে মারা হয় ঐ পরিবারের চারদিন বয়সের এক শিশু ও নারীসহ ১১ জনকে। সে ভিটেমাটি এখনও শূন্য পড়ে আছে। সেখানে ওঠেনি নতুন ঘর। বাড়ি যাবার অবস্থা সৃষ্টি না হওয়ায় বিচার না পাওয়া পরিবারটির বেঁচে থাকা সদস্যদের কাটছে পরবাসী জীবন। ঘটনার সাড়ে ৮ বছরেও নিষ্পত্তি হয়নি মামলার। পরিবারের সদস্যদের প্রশ্ন মহাজোট সরকার আমলেও মামলা এভাবে ঝুলে থাকলে আর কখন পাওয়া যাবে নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের বিচার।

পরিবারের সদস্য মামলার বাদী বিমল শীল মঙ্গলবার জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা তিন ভাই বেঁচে আছি। ঘটনার দিন আমি ছিলাম শ্বশুর বাড়ি। বাকি দুই ভাইয়ের মধ্যে এক ভাই ছিল বিদেশে এবং আরেক ভাই ছিল বাইরে তার কর্মক্ষেত্রে। এ সুবাদেই আমাদের বেঁচে যাওয়া। শূন্য ভিটেতে সাধারণত নতুন ঘর ওঠে। কিন্তু আমাদের পৈত্রিক ভিটেমাটি পড়ে আছে খালি। সেখানে কেউ আর বসবাস করে না। নিজের পৈত্রিক ভিটের সঙ্গে মানুষের আবেগ এবং স্মৃতি জড়িয়ে থাকে। কিন্তু কিছুই করার নেই। এ যেন আমাদের নিয়তি।

বিমল শীল এখন বসবাস করেন চট্টগ্রাম নগরীতে। বাঁশখালীতে তাঁর একটি ওষুধের দোকান ছিল। কিন্তু নিরাপত্তার অভাববোধ থেকে তিনি সেখান থেকে এসে ওষুধের দোকান দেন শহরে। বাকি দুই ভাইয়ের মধ্য একজন এখনও বিদেশে, অপরজন রয়েছেন শিক্ষকতা পেশায়। কারোরই বাড়ি যাওয়া হয় না। কারণ বাড়ি যাওয়া মানেই স্বজন হারানোর বেদনায় ভেঙ্গে পড়া। একান্ত আপন কেউ নেই যাদের জড়িয়ে ধরে সান্ত¡না খুঁজে পাওয়া যাবে। তাছাড়া নেই থাকবার ঘরও।

বিমল শীল জানান, শূন্য ভিটায় ঘর উঠাবার জন্য আমরা সরকারের কাছে আর্থিক সাহায্য চেয়েছিলাম। এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল, দগ্ধ হয়ে নিহত ১১ জনের নামে একটি সড়কের নামকরণের। নিরাপত্তা চেয়ে লিখিতভাবে আবেদন জানানো হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী বরাবরে। কিন্তু কিছুই মেলেনি এখনও। তবে নিরাপত্তা সংক্রান্ত আবেদনের জবাবে প্রায় দু’মাস আগে প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব নজরুল ইসলাম সাক্ষরিত একটি পত্র এসেছে, যাতে আমাদের ছবি ও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র চাওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে এসব জমা দিয়েছি। এখন অপেক্ষার পালা। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের আবেদনও করেছিলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক যে, সে সুযোগ এখনও কেউ করে দেয়নি।

মামলার বর্তমান অবস্থা প্রসঙ্গে বিমল শীল বলেন, সর্বশেষ গত ১৯ এপ্রিল আলোচিত এ মামলার দ্বিতীয় দফা চার্জ গঠিত হয়েছে ৩৭ জনের বিরুদ্ধে। এতে বাদ পড়েছেন সাবেক বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী জাফরুল ইসলাম চৌধুরী এমপির চাচাত ভাই বিএনপি নেতা আমিনুর রহমান চৌধুরী ওরফে আমিন চেয়ারম্যান। উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম জেলা পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এ্যাডভোকেট আবুল হাশেম। এ ব্যাপারে গত ৫ এপ্রিল এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের সঙ্গে সাক্ষাত হয়েছে বলে জানিয়ে বিমল শীল বলেন, তিনি এ ব্যাপারে যথাযথ আইনী সহায়তা দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।

জেলা পিপি এ্যাডভোকেট আবুল হাশেম মামলার অগ্রগতি প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, আমিন চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠিত না হওয়া মানে তাঁকে অব্যাহতি দেয়া নয়। আদালতে আসামির উপস্থিতিতে অভিযোগ গঠন করা হয়। সেদিন তিনি (আমিন চেয়ারম্যান) উপস্থিত ছিলেন না বলেই তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ পড়ে শোনানো হয়নি। তাছাড়া এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতের একটি স্থগিতাদেশও রয়েছে। স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হলে যে কোন সময়ে অন্তর্ভুক্ত হবেন এ আসামি। দফায় দফায় বিচার কাজ বিলম্বিত হওয়া প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি আবুল হাশেম বলেন, প্রথম দফা অভিযোগ যে ধারায় গঠিত হয়েছিল তাতে আমিন চেয়ারম্যানকে সেভাবে অভিযুক্ত করা যায় না। কারণ সেটি ছিল ডাকাতি করতে না পেরে হত্যার মামলা। আমিন চেয়ারম্যান যেহেতু পূর্বে ডাকাতির মতো কোন অভিযোগে অভিযুক্ত হননি, সেহেতু এমন অভিযোগ প্রমাণ করা কষ্টসাধ্য ছিল। এ কারণেই বাদীর পক্ষ থেকে নারাজি দিয়ে ধারা পরিবর্তনের আবেদন করা হয়েছিল। এ আবেদনের প্রেক্ষিতে দ্বিতীয় দফায় চার্জ গঠিত হয়েছে অন্য ধারায়। এতে অভিযোগ আসে সংখ্যালঘু এ পরিবারের সম্পত্তি দখলের লক্ষ্যে ১১ জনকে পুড়িয়ে হত্যা। মামলাটি এখন গতি পেয়েছে বলে উল্লেখ করে পিপি এ্যাডভোকেট আবুল হোসেন বলেন, আগামী মাস থেকেই শুরু হচেছ সাক্ষ্যগ্রহণ।

উল্লেখ্য, ২০০৩ সালের ১৮ নবেম্বর রাতে বাঁশখালীর সাধনপুর শীলপাড়ায় তেজেন্দ্রলাল শীলের বাড়িতে ঘটে এ নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। দুর্বৃত্তরা পরিকল্পিতভাবে ঘরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করে একই পরিবারের ১১ জনকে। এ ঘটনায় তৎকালীন বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী জাফরুল ইসলাম চৌধুরীর চাচাত ভাই আমিন চেয়ারম্যানের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ ওঠে। পরে তিনি মামলার আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হলেও এখনও রয়েছেন আদালতে গঠিত অভিযোগের বাইরে। অনিশ্চয়তার মাঝেও তেজেন্দ্রলাল শীলের পরিবারটি রয়েছে বিচার পাওয়ার আশায়। এ সরকারের আমলেই তাদের সে আশা পূরণ হবে কী।

সূত্র:
দৈনিক জনকণ্ঠ

No comments:

Post a Comment