‘আদর্শহীন রাজনীতির ফল’

ইমরান হোসেন
সাতক্ষীরা থেকে ফিরে

ঢাকা, এপ্রিল ২৫ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)- নাটকে হজরত মুহাম্মদকে কটাক্ষ করা হয়েছে দাবি করে গত ৩১ মার্চ কালীগঞ্জের ফতেপুরে কয়েক ঘণ্টাব্যাপী হামলা-ভাংচুরের ঘণ্টাখানেক পর স্থানীয় সাংসদ এইচ এম গোলাম রেজা সমাবেশ করে ওই আগুনে ঘি ঢেলে দেন।

“এই মুসলমানরা কখনো থামবে না। আল্লাহ ও তার রসুলের জন্য তারা সব সময় সোচ্চার হবে,” সমাবেশে বলেন ক্ষমতাসীন মহাজোট শরিক জাতীয় পার্টির এই নেতা।

ওই সমাবেশে গোলাম রেজার সঙ্গে কৃষ্ণনগর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেনও ছিলেন, যাকে পরে হিন্দু ও মুসলিমদের বাড়িতে হামলাকারীদের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য গ্রেপ্তার করা হয়।

ঘটনার শুরু গোলাম রেজার এই সমাবেশের চার দিন আগে ২৭ মার্চ, স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সেদিন ফতেপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের করা ‘হুজুর কেবলা’ নাটক নিয়ে। এতে হজরত মুহাম্মদকে কটাক্ষ করা হয়েছে ধুয়া তুলে জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীরা স্থানীয়দের ক্ষেপিয়ে তোলে। হামলা হয় নাটকের পাণ্ডুলিপি রচয়িতা এবং ফতেপুর স্কুলের শিক্ষক ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যসহ ১০টি বাড়িতে।

নাটকে হজরত মুহাম্মদের চরিত্র হনন হয়েছে দাবি করে স্থানীয় দৈনিক দৃষ্টিপাত-এ একটি প্রতিবেদন ছাপান জামায়াতের মিজানুর রহমান, এরপর তা ব্যবহার করে ব্যাপক প্রচার চালায় জামায়াত, পরিস্থিতি গড়ায় অবনতির দিকে।

ওই সময় পরিস্থিতি শান্ত করার কথা বলে সমাবেশ করে এতে বক্তব্যে কার্যত হিন্দুদের বাড়িতে হামলায় উস্কানি দিয়েছিলেন গোলাম রেজা, যিনি জেলাটিতে জামায়াতের শক্ত অবস্থানের মধ্যে নির্বাচিত হয়েছেন।

সমাবেশে উপস্থিত স্থানীয় এক সাংবাদিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, সংসদ সদস্যের সমাবেশে একটি প্রাইভেটকার, দুটি মাইক্রোবাস ও ৪০টি মটর সাইকেল নিয়ে প্রায় দেড়শ’ মানুষ অংশ নেয়।

ওই সমাবেশে থাকা এবং পরে গ্রেপ্তার কৃষ্ণনগর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মোশাররফ জাতীয় পার্টির নেতা এবং গোলাম রেজার খুবই ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত।

আওয়ামী লীগের সমর্থনে সাতক্ষীরা-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন গোলাম রেজা। হামলার স্থান ফতেপুর ও চাকদা দুটি গ্রামই তার সংসদীয় এলাকায়।

“এই মুসলমানরা কখনো থামবে না। আল্লাহ ও তার রসুলের জন্য তারা সব সময় সোচ্চার হবে”- হামলাকারীদের সামনে দাঁড়িয়ে গোলাম রেজার ওই বক্তব্য স্থানীয় এক সাংবাদিক তার মোবাইল ফোনে রেকর্ড করেন। ওই রেকর্ডটি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমেরও হাতে এসেছে।

পরিস্থিতি শান্ত করার কথা বলে ওই সমাবেশ ডাকা হলেও সংসদ সদস্যের বক্তব্যে ফতেপুরে সহিংসতার বিরুদ্ধে একটি কথাও ছিল না। বরং সাংসদের সমর্থকরা স্লোগান দিতে থাকেন, “নবীর শত্রু, ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে সতর্ক হোন।”

সমাবেশে গোলাম রেজা পুলিশ প্রশাসনকেও হুমকি দেন। হামলাকারীদের অসহযোগিতা করার পরিণাম ভালো হবে না বলেও হুঁশিয়ারি দেন তিনি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পক্ষ থেকে স্থানীয় সাংবাদিক ও রাজনীতিকসহ অনেকের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে, যারা সবাই বলেছেন- স্থানীয় সংসদ সদস্যের ভূমিকা সহিংসতা উস্কে দিয়েছে। হামলাকারীরা পুলিশের সামনে জড়ো হয়ে শুনতে পায়, সংসদ সদস্য পুলিশকে হুমকি দিচ্ছেন।

গোলাম রেজার বক্তব্যের পরদিন ১ এপ্রিল গোলাম রেজারই সংসদীয় এলাকার চাকদায় একই ধরনের সহিংসতার ঘটনা ঘটে। সেদিন সাতটি হিন্দু বাড়িতে হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

“এটা সত্য যে, তার ওই ভাবে বলা ঠিক হয়নি,” বলেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম।

ফোনে যোগাযোগ করা হলে গোলাম রেজা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওসি ফরিদ, এসপি হাবিব ও কালীগঞ্জ সার্কেল এএসপি নজরুলের নেতৃত্বে পুরো সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। আমাকে ফাঁসাতে তারা এটা করেছিল।”

হামলায় উস্কানিতে জামায়াতের সম্পৃক্ততা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এলেও জাপার এই নেতা বলেন, “আমি মনে করি না যে, এ ধরনের ঘটনায় কোনো রাজনৈতিক দল সম্পৃক্ত ছিল। একটি অপরাধী গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে এটা করেছে।”

সমাবেশের সময় পাশে চিহ্নিত হামলাকারীদের অবস্থানের বিষয়ে তিনি বলেন, “এলাকার গণ্যমান্য সবাই সেখানে উপস্থিত ছিল।”

হামলায় নেতৃত্বদাতা হিসেবে মোশাররফের নাম অনেকে বললেও তার পক্ষ নিয়ে সংসদ সদস্য রেজা বলেন, “এই অভিযোগ ভিত্তিহীন।”

স্থানীয়দের বক্তব্য অনুযায়ী, বিষয়টি এমন নয় যে জামায়াতে ইসলামী এ ঘটনার জন্য জাতীয় পার্টিকে প্ররোচিত করেছে। আদর্শিক কারণেই উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদীদের পক্ষ নিয়েছিল জাতীয় পার্টির স্থানীয় নেতারা। আর যথাযথ রাজনৈতিক শিক্ষার অভাব এবং ভোটের রাজনীতির বিষয়টি মাথায় রেখে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা-কর্মীরাও এতে যোগ দেয়।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য অনুযায়ী, নাটক মঞ্চায়নের সময় প্রথম যিনি বিরোধিতা করেছিলেন তিনি আওয়ামী লীগের এক জন কর্মী।

নাটকের পাণ্ডুলিপি রচয়িতা শাহীনের শ্যালক হাবিবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ফতেপুরের আওয়ামী লীগ কর্মী মিন্টু প্রথমে নাটকটির বিরোধিতা করেন। সঙ্গে সঙ্গেই দর্শকদের মধ্যে তিনি অনেক সমর্থক পেয়ে যান।”

অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ নেতাদের আমন্ত্রণ না করায় তাদের কর্মীরা এমনিতেই ক্ষেপে ছিলেন বলে জানান হাবিবুর।

সাতক্ষীরার এক প্রবীণ সাংবাদিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আওয়ামী লীগ ভিত্তি তৈরি করে দেয় এবং ধর্মের কার্ড ব্যবহার করে জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টা চালায় জাতীয় পার্টি। কিন্তু পরিণামে এটা যে জামায়াতে ইসলামীর স্বার্থ হাসিল করবে, এটা তারা বুঝতে পারেনি।”

“রাজনীতিকদের মধ্যে আদর্শ না থাকলে কী হতে পারে, এটা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ,” বলেন তিনি। তবে এই মন্তব্যে বড় সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের রোষে পড়ার শঙ্কা থেকে নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেন এই সাংবাদিক।

তদন্তকারী, প্রত্যক্ষদর্শী, ক্ষতিগ্রস্ত ও রাজনৈতিক নেতারা সবাই বলেছেন, বিক্ষোভকারীদের মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির অনেকে ছিলেন, যারা এখন অনুতপ্ত যে, প্রকৃত সত্য না জেনে তারা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন।

ওই সাংবাদিক বলেন, “নির্বাচনে জিততে শুরু হওয়া জোট রাজনীতির জন্য আদর্শিক বিচ্যুতি জাতীয় পর্যায় থেকে তৃণমূলেও ঢুকেছে।”

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নজরুল কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।

স্থানীয়রা জানায়, নজরুলের পুরো পরিবার জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং সাতক্ষীরায় বেশিরভাগ আওয়ামী লীগ নেতার ক্ষেত্রেই বিষয়টি একই রকম।

এক সময়কার ছাত্র ইউনিয়নকর্মী ইফতেখার আলী যিনি বর্তমানে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন, তিনি বলেন, “বিএনপির উচিত, জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করা।”

রাজনীতিকদের মধ্যে কলুষতা ছড়িয়ে পড়লেও এই ঘটনাটি নিয়ে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে আশা দেখছেন স্থানীয়রা। তারা বলছেন, অপরাজনীতি যে তরুণদের এখনো গ্রাস করতে পারেনি, এটা তারই স্বাক্ষর।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/ইএইচ/এএইচ/এমআই/১৭৫৮ ঘ.
http://bdnews24.com/bangla/details.php?id=192313&cid=2

1 comment:

  1. স্বাধীন5/01/2012 12:25 AM

    আদর্শহীন রাজনীতি? ইসলামি রাজনীতিকে আপনারা আদর্শহীন বললেন। তাহলেই সেরেছে রে। এখন মুসলমানরা কি বলবে তা জানতে মনচায়।

    ReplyDelete