‘পুলিশ দেখছিল’

সাতক্ষীরা মুসলমান ইসলামী হামলায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হিন্দু বাড়িঘর
সাতক্ষীরা মুসলমান হামলায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হিন্দু বাড়িঘর
ইমরান হোসেন
সাতক্ষীরা থেকে ফিরে

ঢাকা, এপ্রিল ২২ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)- সহিংসতা উস্কে দেওয়ার জন্য দায়ী ‘সাজানো’ সংবাদের প্রতিবেদনকারী জামায়াতে ইসলামীর কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হলে সাতক্ষীরার কালীগঞ্জের ফতেপুর ও চাকদার সহিংস ঘটনা এড়ানো যেত বলে মনে করেন স্থানীয়রা।

উল্টো ওই প্রতিবেদনকে আমলে নিয়ে তার ভিত্তিতে করা মামলা নেয় পুলিশ। আর তাতে জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা ইসলাম ও মহানবীর অবমাননার অজুহাত দেখিয়ে অস্থিতিশীলতা ও সহিংসতা সৃষ্টির সুযোগ পায় বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।

স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ২৭ মার্চ সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার ফতেপুর স্কুলের শিক্ষার্থীরা ‘হুজুর কেবলা’ নামে একটি নাটক মঞ্চস্থ করে।

ওই নাটক নিয়ে স্থানীয় দৈনিক দৃষ্টিপাতে একটি খবর প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়, নাটকে হযরত মুহম্মদের (স.) চরিত্র ‘বিকৃত’ করা হয়েছে। এই সংবাদের প্রতিবেদক ছিলেন জামায়াতকর্মী।

দলীয় নির্দেশনায় সহিংসতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তিনি ওই ‘মিথ্যা’ সংবাদ লেখেন বলে স্থানীয় সাংবাদিক, রাজনীতিক, প্রত্যক্ষদর্শী ও ক্ষতিগ্রস্তরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন।

সৈয়দ আবুল মনসুর আহমদের রম্যরচনা ‘হুজুর কেবলা’ থেকে ওই নাটকের পাণ্ডুলিপি তৈরি করা হয়।

নাটকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত আনার মতো কিছু ছিল না- এ বিষয়টি পুলিশের নজরে আনা হয়েছিল জানিয়ে ফতেপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য আব্দুল হাকিম সরদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ওসি নাটকের পান্ডুলিপি পরীক্ষা করে মূল রচনার সঙ্গে তার হুবহু মিল পেয়েছিলেন।”

২৯ মার্চ রাতে কালীগঞ্জ থানার ওসি সৈয়দ ফরিদউদ্দিনের সঙ্গে তার বৈঠক হয়। ওই ওসিকে পরে সে থানা থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।

দৃষ্টিপাতের ওই প্রতিবেদনের পর মানুষের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়তে থাকায় নাটকের দুদিন পর হাকিম সরদারসহ ফতেপুরের বেশ কয়েকজনকে ডেকে নেয় পুলিশ।

হাকিম বলেন, “প্রকৃত সত্য ধরিয়ে দেওয়ার জন্য তখন ওসি আমাদের ধন্যবাদ জানান এবং এ ধরনের একটি স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে ‘বানোয়াট’ খবর প্রকাশের জন্য প্রতিবেদক মিজানুর রহমানের নিন্দা করেন।”

জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা ওই প্রতিবেদনকে ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচারণা চালানোয় মানুষের মধ্যে দ্রুত অসন্তোষ ছড়াতে থাকলেও ওই প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ।

২৯ মার্চ ও তার পরের দিন জামায়াত কর্মীরা ওই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা প্রচারপত্র বিলি করে এবং লাউডস্পিকারে ঘোষণা দিয়ে ‘ইসলামের শত্রুদের’ বিরুদ্ধে বিক্ষোভের জন্য মানুষকে আহ্বান করে এবং জেলা সদরসহ সাতক্ষীরার বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ করে। তখন পুলিশ কোনো ভূমিকা পালন না করায় পরিস্থিতি সহিংসতার দিকে গড়ায়।

৩০ মার্চ জুমার নামাজের সময় থানা মসজিদসহ সবগুলো মসজিদে ইমামরা এ বিষয়ে বয়ান দেন।

কালীগঞ্জে বিক্ষোভের এক পর্যায়ে স্থানীয় এক সাংবাদিককে ধাওয়া করলে তিনি থানায় আশ্রয় নেন। ঘটনার তিনদিন পর তা নিয়ে বিক্ষোভ কেন- জানতে চেয়েছিলেন ওই সাংবাদিক। বিক্ষোভকারীরা থানায় হামলা চালিয়ে ওই সাংবাদিককে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি জানায়।

বিক্ষোভকারীরা সন্ধ্যা পর্যন্ত কয়েক ঘণ্টা থানা ঘিরে রাখে। ‘অবমাননার’ ঘটনাটি খতিয়ে দেখা হবে বলে বিক্ষুব্ধদের আশ্বস্ত করা ছাড়া কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কালীগঞ্জ থানা পুলিশ।

সেদিনই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে ফতেপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রেজওয়ান হারুন এবং নাটকের নির্দেশক ও ওই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা মিতা রানী বালাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে এ সময় একটি মামলাও গ্রহণ করে পুলিশ। এর ফলে তাদের বিরুদ্ধে ‘মিথ্যা’ অভিযোগ আরো জোরদার হয়। অথচ ওসি ২৯ তারিখ এ অভিযোগের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছিলেন।

বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাতক্ষীরা জেলা শাখার সভাপতি ফাহিমুল হক কিসলু বলেন, “অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে কীভাবে এ ধরনের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যায় - সে কায়দা ভালোই জানে পুলিশ। পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আগে তারা কেন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, তা একটা রহস্য।”

পরদিন ৩১ মার্চ সকালে যখন শত শত মানুষ ফতেপুরে নাটকের পান্ডুলিপিকার শাহীনুর রহমান শাহীনের বাড়িতে হামলা চালালে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ওই বাড়িতে পাঁচটি ঘর ভাংচুর ও মূল্যবান সম্পদ লুট করার পর ঘরগুলোতে আগুন দেয় হামলাকারীরা।

শাহীনের শ্যালক হাবিবুর রহমান বলেন, “তখন সেখানে দুই গাড়ি পুলিশ ছিল। কিন্তু পুলিশ সদস্যরা শুধু দেখছিল এবং নীরব দর্শকের ভূমিকা নিয়েছিল।”

ওই বাড়িতে হামলা চালানোর পর বিক্ষুব্ধরা এরইমধ্যে গ্রেপ্তার করা ফতেপুর স্কুলের সহকারী শিক্ষিকা মিতা রানী বালা, ওই স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য আব্দুল হাকিম সরদার ও লক্ষ্মীপদ মণ্ডলের বাড়িতে হামলা চালিয়ে সেখানে ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এরপর তারা সাতক্ষীরা সাংস্কৃতিক পরিষদের ফতেপুর আঞ্চলিক কার্যালয়ে ভাংচুর করে।

আগুন নেভাতে তারা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের বাধা দেয়। ঘরগুলো আগুনে ছাই না হওয়া পর্যন্ত তারা সেখানে ছিল।

কয়েক ঘণ্টা ধরে এসব হামলা চললেও পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে স্থানীয়রা জানান। এমনকি এ ঘটনায় তারা কোনো মামলাও দায়ের করেনি।

ফতেপুরে হামলার শিকার লক্ষ্মীপদ মণ্ডল বলেন, “আমার ঘরে যখন আগুন দেওয়া হচ্ছিল তখন পুলিশ সিগারেট ফুঁকছিল। তারা এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করছিল এবং পরিস্থিতি ‘নিয়ন্ত্রণের বাইরে’ চলে গেছে বলে ওয়াকিটকিতে বার্তা পাঠাচ্ছিল।”

এর পরের ২৪ ঘণ্টায়ও পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় জামায়াতকর্মীরা আরেক দফা সহিংস ঘটনা ঘটাতে জন্য উৎসাহিত হয়। এবার তারা ভারতীয় সীমান্তের কাছে চাকদায় হামলা করে। হুজুর কেবলা নাটক নিয়ে কথাবার্তার এক পর্যায়ে প্রতিবেশী এক মুসলমান নারীকে এক হিন্দু নারী মুহম্মদকে নিয়ে কটাক্ষ করেছেন-এমন গুজবে সেখানে হামলা হয়।

১ এপ্রিল রাত ৬টার দিকে চাকদায় সাতটি হিন্দু বাড়িতে প্রায় দুই ঘণ্টা লুটপাটের পর অগ্নিসংযোগ করা হয়।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তৌফিক ইলাহী চৌধুরী, তৎকালীন পুলিশ সুপার (এসপি) হাবিবুর রহমান খান, জেলা প্রশাসক আনোয়ার হোসেন হাওলাদার ও পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি রফিকুল ইসলাম দ্রুত ঘটনাস্থলে যান।

এ সময় কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে কর্মকর্তারা শুধু বিক্ষুব্ধদের শান্ত হওয়ার আহ্বান জানান বলে স্থানীয় সাংবাদিকরা জানান। এ সময় দমকলকর্মীদের যেতে বাধাদানকারীদের ঠেকানোর চেষ্টা করায় বছির আহমেদ নামে পুলিশের এক সহকারী উপ-পরিদর্শকের (এএসআই) শাস্তি দাবি করে হামলাকারীরা। ভোর হওয়ার আগে ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হবে বলে হামলাকারীদের আশস্ত করেন অতিরিক্ত ডিআইজি। কথামতো ওই এএসআইকে প্রত্যাহারও করা হয়।

চাকদার ঘটনার পর কোনো মামলা করেনি পুলিশ।

চাকদায় হামলার শিকার কৃষ্ণপদ সরদার বলেন, “হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে একটি কাঁদানে গ্যাসের সেলও ব্যবহার করা হয়নি।”

“এর আগে খবরের কাগজে পড়েছি যে, পুলিশ ও প্রশাসন কাজ করে না। কিন্তু এবার নিজের ক্ষেত্রেই তা দেখেছি”, বলেন ৬৩ বছরের কৃষ্ণপদ।

তার প্রতিবেশি শ্যামাপদ সরদারের বাড়িতেও সেদিন আগুন দেওয়া হয়। শ্যামাপদ বাড়ি ছিলেন না। তাই তার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে গেলে ওই দিনের ঘটনা মনে করে অনেক্ষণ তিনি কোনো কথা বলতে পারছিলেন না।

“পুলিশ হামলাকারীদের উৎসাহিত করেছিল। তা না হলে, তারা অন্তত একটি ফাঁকা গুলি ছুড়তো,” বলেন তিনি।

স্থানীয় সাংবাদিক বা রাজনীতিক কেউই পুলিশের নীরব দর্শকের ভূমিকার ব্যাখ্যা করতে পারেনি। তারা শুধু বলেছে, সহিংসতার সময় পুলিশ কার জন্য কাজ করেছিল তা তারা বুঝতে পারেনি।

চাকদার ঘটনার পর এসপি হাবিবুর রহমান ও কালীগঞ্জ থানার ওসি ফরিদ উদ্দিনকে প্রত্যাহার করা হলেও ঘটনার সময় তাদের রহস্যজনক আচরণের জন্য কোনো জবাবদিহি চাওয়া হয়নি।

প্রত্যাহারের আগে জেলা আইন-শৃঙ্খলা বৈঠকে এসপির মুখে পরিস্থিতি শান্ত করতে তার উদ্যোগের কথা শুনে অনেকেই বিস্মিত হন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই বৈঠকে উপস্থিত একজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, বৈঠকে এসপি বলেন, পরিস্থিতি শান্ত করতে তিনি বিক্ষুব্ধদের বলেছিলেন যে ‘গায়ে পুলিশের পোশাক না থাকলে ইসলাম রক্ষায় আমিও তাদের সঙ্গে যোগ দিতাম’।

ওই পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রত্যাহারের পর অবশেষে গত ৫ ও ৬ এপ্রিল এ ঘটনায় দুটি মামলা করে পুলিশ। এ ঘটনায় এ পর্যন্ত ৫০ জনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। দৃষ্টিপাতের সেই প্রতিবেদককে মিজানুরকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

যে বিক্ষোভ এ সহিংসতার জন্ম দিয়েছিল তার ভিডিওচিত্র ও স্থিরচিত্রে নেতৃত্ব দেওয়া দুই ডজনেরও বেশি ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা গেলেও পুলিশ তাদের নাম উল্লেখ না করে অজ্ঞাতনামা পাঁচশ’ জনকে আসামি করে মামলা করেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সাতক্ষীরার এসপি আসাদুজ্জামান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। ওই ঘটনার পর তাকে এখানের দায়িত্বে আনা হয়েছে বলে জানান তিনি।

স্থানীয় সাংবাদিকরা জানান, ওই দুইদিনের সহিংসতার সময় র‌্যাবও কোনো ভূমিকা পালন করেনি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/ইএইচ/এএইচ/এসইউ/এমআই/২০০০ ঘ.
খবরের সূত্র

1 comment:

  1. এই খবরের উল্লেখযোগ্য অংশ:
    ১. দলীয় নির্দেশনায় সহিংসতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তিনি ওই ‘মিথ্যা’ সংবাদ লেখেন বলে স্থানীয় সাংবাদিক, রাজনীতিক, প্রত্যক্ষদর্শী ও ক্ষতিগ্রস্তরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন।
    ২. আগুন নেভাতে তারা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের বাধা দেয়। ঘরগুলো আগুনে ছাই না হওয়া পর্যন্ত তারা সেখানে ছিল।
    ৩. ফতেপুরে হামলার শিকার লক্ষ্মীপদ মণ্ডল বলেন, “আমার ঘরে যখন আগুন দেওয়া হচ্ছিল তখন পুলিশ সিগারেট ফুঁকছিল। তারা এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করছিল এবং পরিস্থিতি ‘নিয়ন্ত্রণের বাইরে’ চলে গেছে বলে ওয়াকিটকিতে বার্তা পাঠাচ্ছিল।”
    ৪. "সেখানে দুই গাড়ি পুলিশ ছিল। কিন্তু পুলিশ সদস্যরা শুধু দেখছিল এবং নীরব দর্শকের ভূমিকা নিয়েছিল।”
    ৫. “হামলাকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে একটি কাঁদানে গ্যাসের সেলও ব্যবহার করা হয়নি।”
    ৬. ‘গায়ে পুলিশের পোশাক না থাকলে ইসলাম রক্ষায় আমিও তাদের সঙ্গে যোগ দিতাম’

    ReplyDelete