‘জামায়াতের ইন্ধনেই হামলা-আগুন’

সাতক্ষীরা কালিগঞ্জ মুসলমানদের পুড়িয়ে দেওয়া লক্ষীমান্ত মন্ডল বাড়ি
  ইমরান হোসেন
সাতক্ষীরা থেকে ফিরে

ঢাকা, এপ্রিল ২০ (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম)- বিদ্বেষের যে কোনো ধর্ম নেই- সপ্তাহ দুই আগে সেটাই দেখেছে সাতক্ষীরা, সঙ্গে সারা দেশের মানুষ।
ফতেপুরে পুড়িয়ে দেওয়া লক্ষ্মীপদ মণ্ডলের বাড়ি >^
স্থানীয় একটি পত্রিকায় ‘উস্কানিমূলক’ খবর প্রকাশের পর কালীগঞ্জের ঘর-বাড়িতে যে আগুন জ্বলেছে, তাতে একইসঙ্গে পুড়েছে হিন্দু ও মুসলমানের পবিত্র গ্রন্থ গীতা আর কোরআন।

আর ওই ঘটনার পেছনে উস্কানিদাতা হিসাবে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করা দল জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের দিকেই আঙুল তুলেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।

স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে কালীগঞ্জের ফতেপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ২৭ মার্চ ‘হুজুর কেবলা’ নামে একটি নাটক মঞ্চস্থ করে। ওই নাটকে মুসলমানদের শেষ নবী হযরত মোহাম্মদকে (সা.) কটাক্ষ করা হয়েছে- এমন একটি প্রতিবেদন স্থানীয় একটি দৈনিকে প্রকাশিত হওয়ার তিন দিন পর স্থানীয় সাংস্কৃতিককর্মীদের ওপর শুরু হয় তাণ্ডব। ৩১ মার্চ ও ১ এপ্রিল এই সহিংসতা চলে।

প্রথম দিন ক্লাস চলা অবস্থায় ফতেপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে হামলা চালায় ‘ধর্মীয় মৌলবাদীরা’। পাশের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়েও ভাংচুর চালানো হয়।

ওই নাটকের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না থাকার পরও ভাংচুর করা হয় সাতক্ষীরা সাংস্কৃতিক পরিষদের ফতেপুর শাখা কার্যালয়, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য পুরো খুলনা বিভাগে যে সংগঠন সুপরিচিত।

কালীগঞ্জে আসলে কী ঘটেছিল, কেন ঘটেছিল, কারাই বা ছিল এর পেছনে- তা জানতে গত ১৩ থেকে ১৫ এপ্রিল সেখানে অনুসন্ধান চালায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।

ওই ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার, পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২৯ মার্চ দৃষ্টিপাত নামের একটি স্থানীয় পত্রিকায় স্কুলের নাটকটি নিয়ে ‘মিথ্যা’ সংবাদ প্রকাশ করে উস্কে দেওয়া হয় এলাকাবাসীর একটি অংশকে। জামায়াতে ইসলামীর জেলা শাখার নেতারা এই জনতাকে ‘ভুল পথে’ পরিচালিত করেন।

দৃষ্টিপাতের প্রতিবেদনে বলা হয়, “নাটকে বিশ্বনবী মোহাম্মদকে (স.) একজন লম্পট ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করে তার চরিত্র বিকৃত করা হয়েছে। নাটকে দেখানো হয়েছে, নারী সঙ্গের জন্য মোহাম্মদ পাগল ছিলেন এবং একাধিক নারীর সঙ্গে তার অবৈধ সম্পর্ক ছিল।”

কিন্তু ওই নাটকের দর্শক ও আয়োজকরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন, উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে কয়েকজন নাটকে একজন ভুয়া পীরের বিদ্রুপাত্মক উপস্থাপনার প্রতিবাদ জানালে শুরুর পরপরই নাটকটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

ওই নাটক দেখতে সেদিন স্কুলের মাঠে যাওয়া কিশোরী সায়মা আক্তার বলেন, “সাউন্ড সিস্টেম খুব খারাপ ছিল, সংলাপই ঠিকমতো শোনা যাচ্ছিল না। আমি বুঝলাম না কীভাবে মুহাম্মদকে (স.) কটাক্ষ করা হল। তাছাড়া একজন অভিনেতা সংলাপের সময় ‘হুজুর’ বলার সঙ্গে সঙ্গে কয়েক জন লোক তার প্রতিবাদ জানায়। এর পরপরই নাটক বন্ধ হয়ে যায়।”

এই ঘটনার তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা, স্থানীয় আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা এবং নাটকটি যারা দেখেছিলেন- তাদের সবাই একই কথা বলেছেন।

বিএনপির জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ইফতেখার আলী বলেন, “আমরা নাটকের স্ক্রিপ্ট দেখেছি। সংবাদে প্রকাশিত তথ্যের কিছুই আমরা পাইনি। সংবাদটি ছিল পুরো মিথ্যা। মানুষকে বিভ্রান্ত করতেই তা করা হয়েছিল।”

ওই সংবাদের প্রতিবেদক ছিলেন দৃষ্টিপাতের কালীগঞ্জ প্রতিনিধি মিজানুর রহমান, যাকে স্থানীয় বাসিন্দারা জামায়াতে ইসলামীর ‘ক্যাডার’ হিসাবে চেনে।

হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় দৃষ্টিপাতের প্রকাশনার অনুমতি ইতোমধ্যে বাতিল করেছে সরকার।

জামায়াতের ‘শক্ত ঘাঁটি’ হিসাবে পরিচিত সাতক্ষীরা-৪ আসনে ২০০৮ সাল বাদে স্বাধীনতার পর প্রায় সব নির্বাচনেই বিজয়ী হয়েছে জামায়াতে ইসলামী। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে সারা দেশে ১৮টি আসনে জয় পায় জামায়াত, যার মধ্যে সাতক্ষীরার পাঁচ আসনের তিনটিতেই জয়ী হয় তারা।

স্থানীয় সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতারা জানান, ওই নাটক মঞ্চায়নের পরদিন জেলা সদরের বড়বাজার মসজিদের ইমাম মোহাদ্দেস আব্দুল খালেককে ফতেপুর পাঠায় জামায়াতের জেলা শাখা। এই ইমামকে জামায়াতের বিভিন্ন কর্মসূচিতে নিয়মিত অংশ নিতে দেখা যায় বলেও তারা জানিয়েছেন।

খালেক ফতেপুর গিয়ে দৃষ্টিপাতের প্রতিবেদক মিজানুরের সঙ্গে বৈঠক করার পরদিনই ওই পত্রিকায় ‘বিদ্বেষপূর্ণ ও মিথ্যা’ প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়।

সাতক্ষীরার স্থানীয় দৈনিক পত্রদূতের সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ জানান, সংবাদটি প্রকাশের পর জামায়াত নেতারা পত্রিকাটির কয়েক হাজার কপি কিনে পুরো সাতক্ষীরাজুড়ে বিলি করেন। এ কারণে দৃষ্টিপাত কর্তৃপক্ষকে ওইদিনের সংখ্যাটি দ্বিতীয়বার ছাপাতে হয়।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, দৃষ্টিপাতে ওই প্রতিবেদন প্রকাশের পর নাটকের প্রতিবাদ জানিয়ে শহরে যে বিক্ষোভ মিছিল হয় তাতে জামায়াতে ইসলামীর কর্মীদের নিয়ে গঠিত ‘জাতীয় ইমাম সমিতি’র সাতক্ষীরা শাখার নেতাকর্মীদের প্রাধান্য দেখা যায়।

লাউডস্পিকার ব্যবহার করেও সেই প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু মানুষকে জানানোর ব্যবস্থা করা হয়। সেদিন বেশ কয়েকটি পিকআপ ভ্যানে করে ‘ছোটো দাড়িওয়ালা ও পাজামা-পাঞ্জাবি পরা’ অনেক যুবক শহরে এসে ‘ইসলামের শত্রুদের’ বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য মানুষের প্রতি আহ্বান জানায়।

জাতীয় ইমাম সমিতির কালীগঞ্জ শাখার সভাপতি হাফেজ মাওলানা আব্দুল গফুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ইমাম সমিতির জেলা শাখা থেকে তাকে এ ব্যাপারে নির্দেশনা দেওয়া হয়।

“তারা আমাকে ফোন করে। শুক্রবার জুমার নামাজের পর বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার জন্য ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বোঝাতে নির্দেশ দেয়।”

স্থানীয় জামায়াত নেতাদের নেতৃত্বে ওই দিন জেলার বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভও হয়। দৃষ্টিপাতে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে জামায়াতের রাজনৈতিক স্লোগান লেখা প্রচারপত্রও বিলি করা হয়।

দৃষ্টিপাতে ওই ‘খবর’ প্রকাশের পরদিন ৩০ মার্চ জামায়াতে ইসলামীর স্থানীয় নেতাদের পরিচালিত দৈনিক আলোর পরশে একই খবর ছাপা হয়। আর ‘ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা’ যে বিক্ষোভ করেছে, তার সংবাদ প্রকাশ করে দৃষ্টিপাত।

শুক্রবার জুমার নামাজের সময় জেলার মসজিদগুলোতে ইমামরা ওই নাটক নিয়ে বক্তব্য দেওয়ার পর নামাজ শেষে রাস্তায় নেমে আসে কয়েক হাজার মানুষ।

খুতবায় স্থানীয় মসজিদের এক ইমামের দেওয়া বক্তব্য উদ্ধৃত করে কালীগঞ্জের অধিবাসী আনোয়ার বলেন, “আমাদের প্রিয় নবীর চরিত্রের ওপর আক্রমণ হয়েছে। যারা এসব করেছে তারা ইসলামের শত্রু। আমরা এ ঘৃণিত চেষ্টার প্রতিবাদ জানাতে যাচ্ছি। আপনারা কি প্রতিবাদে অংশ নেবেন না?”

ফতেপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য আব্দুল হাকিম সর্দার জানান, মসজিদে ঢোকা ও বের হওয়ার সময় সবাইকে দৃষ্টিপাতের প্রতিবেদনের ফটোকপি এবং বিক্ষোভে যোগ দেওয়ার জন্য প্রচারপত্র বিলি করে জামায়াতকর্মীরা।

মুহাম্মদের ‘চরিত্রহননের’ অভিযোগে ফতেপুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক রেজওয়ান হারুন ও সহকারী শিক্ষিকা মিতা রানী দাসকে পুলিশ গ্রেপ্তার করার পর আরো গতি পায় এই বিক্ষোভ।

৩১ মার্চের সহিংসতা

আবুল মনসুর আহম্মেদের মূল রচনা হুজুর কেবলা থেকে ওই নাটকের জন্য পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলেন শাহীনুর রহমান শাহীন। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জাড়িত থাকার কারণে এলাকায় সুনাম রয়েছে এই পরিবারের।

শাহীনের বড় বোন রাশিদা বেগম বলেন, শনিবার সকালে ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর’ স্লোগান দিতে দিতে দুটো মিছিল তাদের বাড়ির দিকে আসতে দেখেন।

সকাল ১০টার দিকে ফতেপুর প্রাথমিক ও উচ্চ বিদ্যালয়ে ভাংচুর চালানোর পর শাহীনদের বাড়িতে চড়াও হয় মিছিলকারীরা। তারা ভাংচুরের পাশাপাশি সেখানে লুটতরাজও চালায়।

এক পর্যায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন দেওয়া হয় ওই বাড়ির পাঁচ ঘরে। বাড়িতে থাকা কোরআন শরীফও পোড়ে সেই আগুনে।

ওইদিন হামলা শুরুর পরপরই বাড়ি থেকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচান শাহীনের পরিবারের সদস্যরা।

শাহীনের বাবা ৬৫ বছর বয়সী জিয়াদ আলী স্থানীয় মসজিদের মুয়াজ্জিন। তিনি বলেন, “একাত্তরে যারা নৃশংসতা চালিয়েছিল- এরা সেই একই গোষ্ঠী। তাদের রক্তের তৃষ্ণা এখনো মেটেনি।”

শাহীনদের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়ে হামলাকারীরা চড়াও হয় গ্রেপ্তার শিক্ষিকা মিতা রানী বালা, ফতেপুর স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য আব্দুল হাকিম ও লক্ষীপদের বাড়িতে। ফেরার পথে তারা সাতক্ষীরা সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের কালীগঞ্জ শাখা কার্যালয়ে ভাংচুর চালায়।

এ সময় আশপাশের বাড়ির লোকজনও প্রাণভয়ে পালিয়ে যায়। লুট হয় তাদের ঘরবাড়িও।

১ এপ্রিল চাকদায় হামলা

ফতেপুরের ঘটনার পরদিন সেখান থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরের চাকদায় একইভাবে হামলা চালায় হাজারখানেক লোক। হুজুরে কেবলা নাটকে মুহাম্মদের কথিত চরিত্রহানীর সূত্র ধরে এক হিন্দু নারী ফের কটাক্ষ করেছেন- এমন গুজবে চাকদার সাত বাড়িতে এই হামলা হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রায় এক ঘণ্টা ধরে বাড়িগুলোতে লুটের পর ঘরে আগুন দেওয়া হয়। সব পুড়ে ছাই না হওয়া পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করে হামলাকারীরা।

এই ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরেশ সর্দার (৪০) বলেন, “তিনটা অটো ভ্যানে করে ছোটো দাঁড়িওয়ালা লোকজন পেট্রোল নিয়ে আসার আগ পর্যন্ত হামলাকারীরা ভাংচুর ও লুটতরাজ চালাতে থাকে।”

“ঘরগুলো পুড়ে ছাই হওয়া পর্যন্ত তারা বাইরে দাঁড়িয়ে ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর,’ স্লোগান দিতে থাকে”, বলেন পরেশের মা সুনীতি রানী।

হামলার সময় পালিয়ে পাশের একটি জঙ্গলে অবস্থান করছিলেন তিনি।

বিক্ষোভের ভিডিওচিত্র দেখে পুলিশ অন্তত সাতজনের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছে। এরা হলেন- জামায়াতে ইসলামীর কালীগঞ্জ শাখার সদস্য আয়ুব আলী গাজী (৪২), কানপুর কলেজের অধ্যক্ষ জাহাঙ্গীর হোসেন, বালিয়াডাঙ্গা মাদ্রাসার সুপার শামসুর রহমান (৬০), মনপুর মাদ্রাসার শিক্ষক মোস্তফা সরওয়ার (৩৮), কৃষ্ণপুরের শিবিরকর্মী মঞ্জিল হোসেন (২৮), কানপুর মহিলা মাদ্রাসার সুপার হাবিবুর রহমান (৪৫) ও মোহাম্মদপুর দাখিল মাদ্রাসার সুপার এরশাদ উল্লাহ।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জামায়াতের সাতক্ষীরা জেলা কমিটির জেনারেল সেক্রেটারি নুরুল হুদার কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি হাসতে থাকেন।

তার পাশ থেকে জামায়াতের আরেক নেতা এ সময় বলেন, এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য নেওয়ার কিছু নেই। জামায়াত কার্যালয়ে কথা বলতে আসার বিষয়টিও গোপন রাখতে বলেন তিনি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম/ইএইচ/এএইচ/জেকে/১৭২৫ ঘ.
খবরের লিংক

1 comment:

  1. “ঘরগুলো পুড়ে ছাই হওয়া পর্যন্ত তারা বাইরে দাঁড়িয়ে ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবর,’ স্লোগান দিতে থাকে”, বলেন পরেশের মা সুনীতি রানী।-- ভালো শিক্ষাই তারা ইসলাম থেকে পেয়েছে।

    ReplyDelete