হাটহাজারীতে ভাংচুরের ঘটনায় উত্তেজনা :১৪৪ ধারা জারি

চট্টগ্রাম হাটহাজারি হিন্দু লোকনাথ মন্দির ভাংচুর আগুন এমপি মন্ত্রী মিটিং
শুক্রবার রাতে বৈঠকে বসেন মন্ত্রী, এমপি ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা
সমকাল চট্টগ্রাম ব্যুরো/হাটহাজারী প্রতিনিধি
তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুক্রবার চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে তুলকালাম কাণ্ড ঘটেছে। হাজারো লোক ভাংচুর, হামলা ও লুটপাট চালিয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রশাসন অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করেছে হাটহাজারী সদর এলাকায়। শুক্রবার রাতে ঘটনাস্থলে চট্টগ্রামের রাজনৈতিক নেতা, ব়্যাব, পুলিশ, স্থানীয় সাংসদ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত হয়ে বৈঠক করেন। গত রাতে সিদ্ধান্ত হয়, আগামী ১৫ দিন পর্যন্ত হাটহাজারীর ঘটনায় সংশ্লিষ্ট এলাকায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ মোতায়েন থাকবে। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়ানোর জন্য সার্বক্ষণিক নজরদারি রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে অনেকে বলেছেন, উদ্ভূত পরিস্থিতির পেছনে জামায়াত-শিবিরের ইন্ধন রয়েছে।

ঘটনার সূত্রপাত হয় বৃহস্পতিবার দুপুরে হাটহাজারীর নন্দীরহাট এলাকায়। নন্দীরহাটের লোকনাথ আশ্রমে উৎসব চলছিল। উৎসব চলাকালে কে বা কারা ওই এলাকায় থাকা একটি মসজিদে দুটি পাথর ছুড়ে মারে। পাথর ছোড়াকে কেন্দ্র করে উভয় পক্ষের মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়। এরই জের ধরে এলাকার কতিপয় লোক সংঘবদ্ধ হয়ে মন্দির ও প্রতিমা ভাংচুর করে। ফলে এলাকায় গোলযোগ ছড়িয়ে পড়ে। উত্তেজিত উভয়পক্ষের লোকজনের মধ্যে সংঘর্ষ বাধলে পুলিশ এসে তা নিয়ন্ত্রণ করে। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকের পর এলাকা শান্ত হয়ে আসে। কিন্তু শুক্রবার সকালে এলাকার কিছু লোক গুজব ছড়িয়ে নন্দীরহাট এলাকায় রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়। ফলে আটকে যায় শত শত গাড়ি। ব্যারিকেড দেওয়ার খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। পুলিশের হস্তক্ষেপে ব্যারিকেড তোলার জন্য যখন তৎপরতা চলছিল তখন হাটহাজারী সদরে ঘটে যায় অপ্রীতিকর ঘটনা।

আগের ঘটনার জের ধরে জুমার নামাজের পর হাজারো মানুষ জড়ো হয়ে হাটহাজারী অবরোধে যোগ দেয় এবং ভাংচুর চালায়। এ সময় বিভিন্ন দিক থেকে অচেনা লোকজন লাঠিসোটা নিয়ে ভাংচুর করে। একপর্যায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। অজ্ঞাতপরিচয় যুবকের তাণ্ডবের কারণে কেউ এগুলো রক্ষা করতে এগিয়ে আসেনি। প্রায় ছয় ঘণ্টা ধরে তাণ্ডব চলে। একপর্যায়ে হাটহাজারী বাজারে এসে দোকানপাট লুটপাট করে। অনেক দোকানে আগুনও ধরিয়ে দেয়। আতঙ্কে লোকজন এলাকা ছেড়ে দূরে চলে যেতে বাধ্য হয়। রাতে বিজিবি, র‌্যাব উপস্থিত হলে এলাকা ছেড়ে যায় অজ্ঞাতপরিচয় লোকজন। বিডিনিউজ জানায়, উদ্ভূত পরিস্থিতিকে অস্থির করতে স্থানীয় জামায়াত-শিবিরের ইন্ধন রয়েছে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের প্রশাসক এমএ সালাম।
এরই মধ্যে অভিযোগ ওঠে, হাটহাজারীতে অবস্থিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বুধবার সংঘটিত ঘটনায় দুই শিবির কর্মী নিহত হওয়ার প্রতিশোধ নিতে জামায়াত-শিবির পরিকল্পিতভাবে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার কারণে ইসলামী ছাত্রশিবিরের শত শত নেতাকর্মী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের গ্রামগুলোতে অবস্থান করছে। তারাই এলাকার সম্প্রীতি নষ্ট করতে গ্রামবাসীকে নেপথ্যে থেকে উসকে দিতে পারে বলে ধারণা করছে পুলিশ। বিষয়টি খতিয়ে দেখছে প্রশাসন। কারণ হাটহাজারীর ফতেয়াবাদ এলাকায় কোনো দিন সম্প্রীতি বিনষ্টের ঘটনা ঘটেনি।

তবে ঘটনার সঙ্গে জামায়াত কোনোভাবে জড়িত নয় বলে দাবি করেন নগর জামায়াতের আমির মাওলানা সামশুল ইসলাম এমপি। তিনি সমকালকে বলেন, মিথ্যা-ভিত্তিহীন অভিযোগ করে বিষয়টিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা চলছে। এ ঘটনার পেছনে জড়িত কারা, তাদের খুঁজে বের করার দায়িত্ব সরকারের। তবে সবচেয়ে বড় কাজ, এর জের ধরে যাতে অন্যত্র অপ্রীতিকর ঘটনা ছড়িয়ে না পড়ে, সে ব্যবস্থা করা। এ ধরনের ঘটনায় তিনি নিজেও উদ্বিগ্ন বলে সমকালের কাছে উল্লেখ করেন।

ঘটনাস্থল থেকে সমকালের হাটহাজারী প্রতিনিধি জানান, শুক্রবার সকালে চারদিকে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। সেই গুজবকে কেন্দ্র করে সকাল সাড়ে ১০টায় নন্দীরহাট ডোপার দীঘিরপাড় এলাকায় রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে ব্যারিকেড দেয় শত শত মানুষ। বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। দুর্ভোগে পড়েন খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি পার্বত্য এলাকার শত শত যাত্রী। জুমার নামাজের পর বিভিন্ন স্থান থেকে মিছিল নিয়ে লোকজন নন্দীরহাটসহ হাটহাজারী সদরে জড়ো হতে থাকে। তারা হাটহাজারী বাজারে অবস্থিত সেবাশ্রমে আগুন লাগিয়ে দেয়। আগুন নেভাতে দমকল বাহিনীর গাড়ি এলেও বাধা দেয় তারা। এ সময় স্থানীয় সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ মোহাম্মদ ইসমাঈল, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ ফরিদ আহমেদসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের শান্ত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।

বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম সমকালকে বলেন, হাটহাজারীর ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা বাইরের লোক। তাদের কেউ কখনও এলাকায় দেখেনি। তারা হঠাৎ করে জ্বালাও-পোড়াও স্লোগান দিয়ে একটি গোলযোগ বাধায়। পরে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে।
স্থানীয় বিএনপি নেতা মাহাবুল আলম সমকালকে বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীরা জড়িত নয়। কারণ এলাকার সুনাম নষ্ট হবে_ এমন কাজ বিএনপি করবে না। তিনি বলেন, ঘটনায় যারা জড়িত ছিল তাদের সবাই বাইরের লোক। তাদের কে এনেছে বা কীভাবে এসেছে, আমরা জানি না।

হাটহাজারী থানা বিএনপির সভাপতি এসএম ফজলুল হক পরিস্থিতির অবনতির জন্য প্রশাসনিক ব্যর্থতাকেই দায়ী করেন। তিনি বিডিনিউজকে বলেন, প্রশাসন শুরু থেকে তৎপর থাকলে পরিস্থিতি এতদূর গড়াত না। এলাকায় সম্প্রীতি রক্ষায় বিএনপির সব নেতাকর্মীকে কাজ করতে বলা হয়েছে জানিয়ে ফজলুল হক বলেন, এখন সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে।

বৃহস্পতিবার ঘটনার পরও প্রশাসনের পক্ষ থেকে আগাম কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। শুক্রবার ঘটনাস্থলে পুলিশ ও র‌্যাব উপস্থিত থাকলেও তাদের নিষ্ক্রিয় ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়। হাটহাজারীর ঘটনা জুমার নামাজের পর শুরু হলেও সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনো পুলিশ দেখা যায়নি। ফলে নির্বাহী কর্মকর্তা উদ্যোগী হয়ে ১৪৪ ধারা জারির ঘোষণা দেন। সন্ধ্যায় ১৪৪ ধারা ঘোষণার পরও হাটহাজারী বাজারের বিভিন্ন দোকানে লুটপাট চলতে থাকে। সন্ধ্যা ৭টার দিকে আওয়ামী লীগ নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, মন্ত্রী আফছারুল আমীন, সিডিএ চেয়ারম্যান আবদুস সালাম, স্থানীয় সাংসদ ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিয়ে হাটহাজারী মাদ্রাসায় বৈঠক করেন। রাত ৮টায় বর্ডার গার্ড সদস্যরা ঘটনাস্থলে পৌঁছার পর হামলাকারীরা সরে যায়। রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা বলবৎ ছিল। পরিস্থিতি প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে আছে বলে জানা গেছে।

দৈনিক সমকাল

No comments:

Post a Comment