দেশে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা কমছে

আদমশুমারির তথ্য মতে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা কমেছে প্রায় ২৪ শতাংশ

শেখ সাবিহা আলম


দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সংখ্যা কমছে। গত ১১টি আদমশুমারির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা কমেছে প্রায় ২৪ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, আগামী বছর যে আদমশুমারি হতে যাচ্ছে, তাতে ওই জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বর্তমানের চেয়েও কমে আসতে পারে।
আদমশুমারির তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯০১ সালে বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চলে হিন্দু জনগোষ্ঠী ছিল মোট জনগোষ্ঠীর ৩৩ শতাংশ। স্বাধীন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত প্রথম আদমশুমারিতে এই হার দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ৫ এবং ২০০১ সালের শুমারিতে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ। তবে, একই সময়ে বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুর সংখ্যায় তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। আর ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা অনেক বেড়েছে।
বিবিএসের কর্মকর্তাদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে জন্মহার কম এবং অভিবাসনের হার বেশি হওয়ায় দেশে তাদের সংখ্যা কমে আসছে। কিন্তু জন্মহার কম হওয়ায় একটি জনগোষ্ঠী ছোট হয়ে আসছে, এই বক্তব্যের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পপুলেশন রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিংয়ের (নিপোর্ট) কয়েকজন কর্মকর্তা ও গবেষক।
নিপোর্টের কর্মকর্তাদের মতে, মূলত দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণেই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা কমছে। এর পেছনে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য এবং বিদেশে সামাজিক মর্যাদা ও উন্নততর জীবন পাওয়ার সুযোগ বড় ভূমিকা রাখছে। এ ছাড়া, ২০০১ সালের নির্বাচনের পর সহিংসতায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হিন্দু ধর্মাবলম্বী দেশ ছেড়েছে। ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনে বাধা, চাঁদাবাজি, লুটপাট, সম্পদ ধ্বংস, দৈহিক নির্যাতন, বিশেষত, ধর্ষণ ও পরিবারের সদস্যদের প্রাণহানির কারণে এরা দেশ ছাড়ে। এর একটি প্রভাব ২০১১ সালের আদমশুমারিতে পড়বে বলেও ধারণা করছেন তাঁরা।
বিবিএসের হিসাব অনুযায়ী, একসময় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যাধিক্য ছিল যেসব জেলায় সেই গোপালগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ঠাকুরগাঁও, খুলনা, দিনাজপুর ও বাগেরহাটে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা কমে গেছে। একমাত্র নড়াইল ছাড়া অন্যসব জেলায় ১৯৯১ সালের পর হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা কমেছে। শুধু নড়াইলে ’৯১ সালে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ২৫ দশমিক ৫ শতাংশ, যা ২০০১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৩১ দশমিক ৪৯ শতাংশে।
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, দেশের সব কটি বিভাগে মুসলমান জনগোষ্ঠীর খানার (হাউসহোল্ড) তুলনায় সংখ্যালঘুদের খানা আকারে ছোট। ১৯৯১ সালের আদমশুমারি অনুসারে একটি সংখ্যালঘু খানার গড় সদস্যসংখ্যা ৪ দশমিক ৯। সেই তুলনায় একটি মুসলমান খানার সদস্যসংখ্যা গড়ে ৫ দশমিক ৬।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ১৯০১ সালে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ৬৬ দশমিক ১ শতাংশ। স্বাধীন বাংলাদেশে এই সংখ্যা ৮৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০০১ সালের আদমশুমারিতে ৮৯ দশমিক ৬ শতাংশে উন্নীত হয়। দেশ বিভাগের কারণে ১৯৪১—৪৭ সাল পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মুসলমানদের আগমন এবং প্রায় সব সময়ই মুসলমানদের মধ্যে উচ্চ জন্মহার বজায় ছিল বলে বিবিএসের তথ্য থেকে জানা যায়।
অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুর মধ্যে ১৯৭৪ সালে এ দেশে বৌদ্ধদের সংখ্যা ছিল মোট জনগোষ্ঠীর দশমিক ৬ শতাংশ। ২০০১ সালেও এই হার অপরিবর্তিত ছিল। একই সময়ে খ্রিষ্টানদের সংখ্যা ছিল দশমিক ৩ শতাংশ। এই সংখ্যারও কোনো পরিবর্তন হয়নি।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান এ কে এম নূরুন্নবী প্রথম আলোকে বলেন, জনসংখ্যার কাঠামোতে ধর্মভিত্তিক জনগোষ্ঠীগুলোর বাড়া-কমা এবং এর কারণ সম্পর্কে বাংলাদেশে খুব একটা গবেষণা হয়নি। তবে কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কম হলে শেষ পর্যন্ত মোট জনসংখ্যায় ওই সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা কম হতে পারে।
কিন্তু নূরুন্নবীর এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন নিপোর্টের পরিচালক ও গবেষক আহমেদ আল সাবির। তিনি বলেন, এ কথা সত্য যে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে জন্মহার কম এবং পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রমে তাদের অংশগ্রহণের হার বেশি। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, এতে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা কমে আসবে। যেমন, এক পরিবারে যদি আট ভাইবোন থাকে এবং পরবর্তী সময়ে যদি তাদের একটি করেও সন্তান হয়, তাহলে জনসংখ্যা না কমে বরং বেড়ে ১৬ জনে পৌঁছাবে। বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে জন্মহার কম হলেই সংখ্যা কমে আসার যুক্তি এখনো বাস্তবসম্মত নয়।
ধর্মভিত্তিক কোনো গবেষণা হয়নি বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অভিবাসনের কারণে জনসংখ্যা কমে আসার বিষয়টি অধিকতর সত্য বলে তিনি মনে করেন। আদমশুমারির প্রতিবেদনে অভিবাসনের কথা উল্লেখ করা হলেও ঠিক কত সংখ্যক হিন্দু ধর্মাবলম্বী স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে দেশ ছেড়েছে এবং কেন ছেড়েছে, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই।
বেসরকারি পর্যায়ে কয়েকজন গবেষক বিষয়টি নিয়ে কাজ করেন। অর্থনীতিবিদ আবুল বারাকাত তাঁদের অন্যতম। তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় এ দেশে ৪৫ শতাংশ ভূমির মালিক ছিল হিন্দুরা। অর্পিত সম্পত্তি আইনের সুযোগ নিয়ে অনেকে এই জমিগুলো গ্রাস করেছে। ফলে দেশ ছাড়তে হয়েছে অনেক হিন্দু পরিবারকে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের গবেষণা ও মূল্যায়ন বিভাগের গবেষক মোহাম্মদ রফি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি গবেষণায় দেখেছেন, অত্যাচারের কারণে অনেক সময় হিন্দুরা দেশ ছাড়ছে। এ ছাড়া, অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ুয়া সন্তান আছে যে পরিবারগুলোর, তারা সন্তানের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বাংলাদেশ ছাড়ছে। শুধু ভারত নয়, এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও অভিবাসন হচ্ছে। মুসলমানেরাও কাজের খোঁজে এসব দেশে যাচ্ছে। তবে, নির্যাতনের জন্য দেশ ছেড়ে যাওয়ার যে ধারা, তা বন্ধে কোনো সরকারই কার্যকর উদ্যোগ নেয় না।
রফি তাঁর একটি গবেষণাগ্রন্থে দেখিয়েছেন, ২০০১ সালে নির্বাচনের মাস অক্টোবর থেকে ২০০২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১২০টি উপজেলায় সংখ্যালঘুদের, বিশেষ করে, হিন্দুদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনে বাধা দেওয়া হয়েছে। ১৯০টি উপজেলায় এরা চাঁদাবাজির শিকার হয়েছে। ১৩৭টি উপজেলায় সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়। ১২৮টি উপজেলায় সহায়সম্পদ লুটের ঘটনা ঘটে। ১৬২টি উপজেলায় সম্পত্তি ধ্বংস হয় এবং ২০২টি উপজেলায় হিন্দুরা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা প্রতিবাদ না জানিয়ে দেশ ছাড়ে বলে সম্পত্তি দখলের জন্য তাদের ভয়ভীতি দেখানোর চেষ্টা হয়। সরকার সংখ্যালঘুদের দেশ ছেড়ে যাওয়া বন্ধে কোনো উদ্যোগ নেয় না। বরং কিছুটা নির্বিকার আচরণ করে।
বিবিএসের আদমশুমারি উইংয়ের প্রধান অসীম কুমার দে বলেন, শতকরা হিসাবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা কমছে বলে মনে হতে পারে। কিন্তু সংখ্যার হিসাবে এই সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা কমছে না। মুসলিম পরিবার এবং হিন্দু পরিবারগুলোর মধ্যে মোট সদস্যদের যে পার্থক্য, তা ক্রমেই বড় হচ্ছে। অভিবাসনের কারণটিও স্বীকৃত। কিন্তু কত মানুষ দেশ ছাড়ছে, সে বিষয়ে কখনো বিশদ কোনো জরিপ হয়নি। ভবিষ্যতে বিষয়টি তাঁরা জরিপে অন্তর্ভুক্ত করবেন।

দৈনিক প্রথম আলো. ০৫.০৯.২০১০ । লিঙ্ক

No comments:

Post a Comment