সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ব্রিটেনে এবং বাংলাদেশে

মহিউদ্দিন আহমদ

৬ মে তারিখে যুক্তরাজ্যে যে সাধারণ নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল, তার মূল্যায়ন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, মানুষজন এবং সংগঠন বিভিন্নভাবে করে চলেছে এখনও। ধারণা করি, এই প্রক্রিয়া আরও কিছুদিন চলতে থাকবে। ব্রিটিশ কনজারভেটিভ পার্টির নেতা ডেভিড ক্যামেরন এবং ব্রিটিশ লিবারেল পার্টির নেতা নিক ক্লেগ ৫ দিনের দর কষাকষি শেষে একটি 'কোয়ালিশন' সরকার গঠন করতে সক্ষম হবেন, তা অনেকেই এখনও বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না। কারণ চরিত্রগতভাবে লিবারেল পার্টিটি কনজারভেটিভ পার্টির তুলনায় লেবার পার্টির অনেক কাছাকাছি; সুতরাং কোয়ালিশন সরকার হলে তা লেবার পার্টি এবং লিবারেল পার্টির মধ্যেই হবে, তাই ছিল অনেকের প্রত্যাশা। কিন্তু তা না হয়ে কোয়ালিশনটি যখন কনজারভেটিভ এবং ডেমোক্রেটিক লিবারেলদের মধ্যে হলো তখন অনেকেই এই কোয়ালিশন সরকারকে কিছুটা উপহাস করে নাম দিল 'কনডেম' (CONDEM) সরকার; কনজারভেটিভ পার্টি এবং ডেমোক্রেটিক লিবারেল পার্টি দুটোর নামের প্রথম একটু করে অংশ নিয়ে এই নামকরণ!
ইংরেজী সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলোর মধ্যে দুনিয়ার সবচাইতে প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত লন্ডনের 'ইকোনমিস্ট' পত্রিকাটি নির্বাচনপরবর্তী ১৫ মে-২১ মে তারিখের সংখ্যায় ৬ মে তারিখের নির্বাচনকে 'ব্রিটেন'স একসিডেন্টাল রেভোলিউশন' (Britain’s accidental revolution) হিসেবে বর্ণনা করেছে। প্রায় দু'শ' বছরের মধ্যে কনিষ্ঠতম প্রধানমন্ত্রী, ৬৫ বছরের পর আর একটি কোয়ালিশন সরকার এবং এই প্রথমবারের মতো কনজারভেটিভ এবং লিবারেলদের নিয়ে একটি সরকার, এইসব কারণ দেখিয়ে 'ইকোনমিস্ট' পত্রিকাটি এই নির্বাচনটিকে একটি 'অপ্রত্যাশিত বিপ্লব' বলেই বর্ণনা করেছে।

রাজনীতিতে যে প্রায় সবকিছুই সম্ভব তাও প্রমাণ করেছে এই ব্রিটিশ নির্বাচনটি। এই দুই দলের নেতারা যখন একটি কোয়ালিশন সরকার গঠনের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা শুরু করেন, তখন তারা দেশের স্বার্থকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। সরকার গঠনের পরও তারা এই একই কথা বলেছেন; দেশের স্বার্থে তারা একটি স্থিতিশীল সরকার নিশ্চিত করবেন, এই কথাটিও তারা কয়েকবার বলেছেন। সেই একই বিবেচনায় গর্ডন ব্রাউনও যখন বুঝতে পারলেন, 'লিবারেলরা তার সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠনে আগ্রহী নয়, তখন তিনি পদত্যাগ করে সসম্মানে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বিদায় নিলেন; বিদায় নিলেন তিনি তার লেবার পার্টির নেতৃত্বের পদ থেকেও। বিদায় নিয়ে তিনি চলে গেলেন স্কটল্যান্ডে তাঁর নির্বাচনী এলাকায়। তিনি আর লন্ডনে থাকলেন না। ক্ষমতায় থাকার জন্য তিনি কোন ষড়যন্ত্র-চক্রান্তে লিপ্ত হলেন না; নির্বাচনে তাঁকে জোর করে হারিয়ে দেয়া হয়েছে এমন কোন অভিযোগও তুললেন না। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেয়ে জালিয়াতির নির্বাচনের অভিযোগ তুলে প্রতিবাদে তিনি হরতাল ধর্মঘটের ডাকও দিলেন না। একজন প্রকৃত গণতন্ত্রপ্রেমিক এবং ভদ্রলোকের মতোই তিনি তাঁর উত্তরসূরিকে শুভকামনা জানালেন; উত্তরসূরি ডেভিড ক্যামেরনও তাঁর পূর্বসূরি গর্ডন ব্রাউনকে দীর্ঘকাল ধরে যুক্তরাজ্যে রাজনীতির মাধ্যমে তাঁর দেশসেবা, পাবলিক সার্ভিসের জন্য সাধুবাদ, ধন্যবাদ জানালেন।

দুই
এই ব্রিটিশ নির্বাচনটিকে আমিও এক ধরনের 'বিপ্লব' হিসেবে দেখছি। এই প্রথম বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত একজন ব্রিটিশ 'হাউজ অব কমন্স'-এর সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হলেন। নির্বাচিত যিনি হলেন তিনি আবার একজন মহিলা। খুব সম্ভব তিনি এখনও অবিবাহিতা। এখানে লক্ষ করার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশে চলছে মহিলাদের বোরখা আর নিকাব পরানোর আন্দোলন, আর তার বিপরীতে হাজার হাজার মাইল দূরে আমাদেরই গোত্রের এক মহিলার ব্রিটিশ সংসদে সফল নির্বাচন! কবি শামসুর রাহমানকে সিলেটে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন ওখানকার কট্টর মৌলবাদীরা, আর ওখানেই জন্ম এই ব্রিটিশ এমপি রোশনারা আলীর!

৬৫০ আসনবিশিষ্ট ব্রিটিশ 'হাউজ অব কমন্স'-এ শুধু রোশনারা আলী নামের এক তরুণী মহিলা সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন, তা তো নয়, নির্বাচিত হয়েছেন পাঁচ-পাঁচজন দক্ষিণ এশীয় মহিলা_ পাকিস্তান বংশোদ্ভূত শাবানা মাহমুদ এবং ইয়াসমীন কোরেশী, ভারতীয় বংশোদ্ভূত ভেলেরি ভাজ এবং প্রীতি প্যাটেল। এই পাঁচজনের শুধুমাত্র প্রীতি প্যাটেল কনজারভেটিভ পার্টির নমিনেশন নিয়ে প্রার্থী হয়েছিলেন; অন্য চারজনের সকলেই লেবারদলীয় প্রার্থী ছিলেন। তারপর, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের উচ্চকৰ হাউজ অব লর্ডসের এক সদস্য ব্যারোনেস সাঈদা ওয়ার্সি ডেভিড ক্যামেরনের কোয়ালিশন সরকারে একজন মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পেয়েছেন; তিনি দায়িত্ব পেয়েছেন কনজারভেটিভ পার্টির প্রধান হিসেবেও। অন্যদিকে লেবার পার্টির প্রধান হিসেবে গর্ডন ব্রাউনের পদত্যাগের পর ঐ শূন্য নেতার পদে আরও পাঁচ-ছয়জনের সঙ্গে প্রার্থী হয়েছেন এক কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা এমপিও; তার নাম ডিয়ানে এবোট। তিনি জ্যামাইকান বংশোদ্ভূত।

দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে যুক্তরাজ্যে বসতি গড়ে তুলেছেন লাখ লাখ মানুষ, বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ড, বর্ণ ও ধর্মের। উপরে যে পাঁচ মহিলা এমপির নাম উল্লেখ করেছি তারা সকলেই শুধুমাত্র দৰিণ এশিয়ার। কিন্তু দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্তের এত ব্যাকগ্রাউন্ড, বর্ণ ও ধর্মের মোট কত জন এমপি নির্বাচিত হয়েছেন ৬৫০ জনের হাউজ অব কমন্সে, তার তালিকাটি এখনও যোগাড় করতে পারিনি। আমার ধারণা, পুরুষ মহিলা মিলিয়ে এই তিনটি বড় দল থেকে নির্বাচিত এমন এমপিদের তালিকাটি বড়ই হবে।

তিন
আমরা আনন্দের সঙ্গেই লক্ষ করছি যে, যুক্তরাজ্যে বিভিন্ন শ্রেণীর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষজনও ঐ দেশের সমাজ এবং রাজনীতিতে দ্রুতগতিতেই গুরুত্ব, ইজ্জত, মর্যাদা এবং ক্ষমতা পাচ্ছেন। ঐ দেশে যে এখনও বৈষম্য নেই, তা কিন্তু নয়। কিন্তু যারা এখনও ব্রিটিশ আভিজাত্যের দোহাই দিয়ে বৈষম্য চালিয়ে যেতে চায়, যেমন ওখানকার বিএনপি (ব্রিটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি), তারা ঐ দেশের মোট জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী মাত্র। এই দেশটির বড় দলগুলো এবং প্রায় সকল নাগরিকই ব্রিটেনে একটি 'মাল্টি-রেমিয়েল, মাল্টি-রিলিজিয়াস এবং মাল্টি-কালচারাল' সমাজ গড়ে তুলতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। সকল শ্রেণীর মানুষের কল্যাণ কামনা করে তারা, সকল শ্রেণীর মানুষের কল্যাণে কাজ করে তারা। বর্ণবৈষম্য ঐ দেশের একটি অপরাধ। সহনশীল সমাজ বলেই তাদের ঐ দেশে মন্দির এবং মসজিদের ব্যাপক বিস্তার ঘটে চল্ছে। কোন ধর্মের শান্তিপূর্ণ প্রচারে তারা বাধা দেয় না। আমাদের দেশের সাঈদীকেও তারা বারবার ভিসা দেয়। দুই বছর আগে যখন লন্ডনের বাস-ট্রেনে ইসলামী জঙ্গীরা বোমা হামলা চালিয়ে প্রায় ৬০ জনকে হত্যা করল, তখনও কিন্তু ঐ দেশে বসবাসকারী মুসলমান জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কোন দায়িত্বশীল দলের কোন নেতা উগ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি। পাকিস্তানের সঙ্গে ঐ হামলাকারীদের নানান রকমের সম্পর্ক থাকার বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ার পরও কোন 'মেইন্স্ট্রিম' দলের কোন নেতা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে লক্ষ করে কোন বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা বলেননি। ব্রিটিশ সরকার ও ব্রিটিশ নেতৃবৃন্দের বিপরীতে আমাদের উম্মাহ্ কওমের দেশগুলোকে তুলনা করুন। উম্মাহ্ কওমের এইসব মুসলমান ভাই আমাদের যে শুধু 'মিসকিন' হিসেবে বর্ণনা করে, তা তো নয়; আমাদের বাংলাদেশীদের কেউ যদি কোন ছোটখাটো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে ও জড়িয়ে পড়ে, 'কালেকটিভ পিউনিটিভ্ মেজার্স'-এর অংশ হিসেবে, বাংলাদেশী শ্রমিকদের উম্মাহ কওমের ভাইয়েরা তাদের দেশ থেকে 'ডিপোর্ট' করার হুমকি দেয়, বৈধ কাজ নিয়ে আমাদের যারা ঐসব দেশে যেতে চায়, তাদের ভিসা দেয়া হয় না। আমাদের সরকার এবং ঐসব দেশে কর্মরত আমাদের দেশের মানুষগুলোকে নানা রকমের চাপে রাখে আমাদের উম্মাহ কওমের এইসব ভাইবেরাদাররা। 'নাসারা'দের দেশ আমেরিকাকে আমাদের মোল্লা মৌলভীরা যতই ঘৃণা করুক না কেন, তাদের ছেলেমেয়েরা সুযোগ পেলেই ঐ দেশের দিকে পঙ্গপালের মতোই ছুটবে। সুযোগসুবিধার উপস্থিতি, আর্থিক সচ্ছলতা, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এসবের আড়ালে পড়ে যায় তখন এই জেহাদীদের ধর্মবিশ্বাসটা।

চার
আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের মানুষগুলো ঐসব দেশে কেমন সমাদৃত হচ্ছে তার ব্যাকগ্রাউন্ডে, আমাদের দেশেই জন্ম যেসব মানুষের, তারা ধর্মীয় বা জাতিগত কারণে সংখ্যালঘু হওয়ার 'অপরাধে' কেমন লাঞ্ছিত এবং নিগৃহীত হচ্ছে, তা আমরা পত্রিকার পাতা খুললেই প্রতিদিন দেখতে পাই। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হলে এদের অবস্থার একটু উন্নতি ঘটে। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ফিরিয়ে আনার লক্ষে তিনি আগেরবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যে সন্তু লারমার সঙ্গে একটি চুক্তি করেন। এইবারও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর দেশের কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ও পদে সংখ্যালঘু মানুষদের উপস্থিতি দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু তা কোনভাবেই তাদের সংখ্যার তুলনায় আনুপাতিক হারে নয়। শকতরা ১০ জন যদি সংখ্যালঘু হয়ে থাকেন, তাহলে আমাদের জাতীয় সংসদের ৩৪৫টি আসনের ৩৪ জন সংসদ সদস্য থাকার কথা, ৬০ জন মন্ত্রিসভার মধ্যে ৬ জন তাদের থাকার কথা। কিন্তু তা কি আছে? তারপর '৯৬-তে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তিটি করলেন বটে, কিন্তু সেই শান্তি চুক্তির বাস্তবায়নে তেমন 'সিরিয়াস' উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে মনে হয় না।

জেনারেল জিয়াউর রহমান সেই যে সংঘাত সংঘর্ষের বীজ বপন করে আসলেন, তা যে কখন শেষ হবে, তা বোধহয় কোন 'রকেট্ সাইন্টিস্ট'ও বলতে পারবেন না। জামায়াত-জাতীয়তাবাদীরা, তাদের নেতা নিজামী এবং খালেদা জিয়ারা ওখানকার বাঙালীদের একটি শ্রেণীকে উস্কিয়েই চলেছেন। একটি প্রশ্ন আমাদের কোন সম্পাদক সাংবাদিক খালেদা জিয়াকে কখনও করেননি, ভবিষ্যতেও তারা করবেন এমনটি আশা করি না। প্রশ্নটি হলো, ফিলিস্তিনীদের জায়গা জমিতে ইহুদীরা হাজার হাজার বসতবাড়ি জোর করে গড়ে তুলেছে ইসরায়েলি সরকারের আগ্রাসী নীতির বাস্তবায়নে। অবস্থাটা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, ফিলিস্তিনের ফিলিস্তিনী চরিত্রটাই বদলে দিচ্ছে ইহুদীরা। সর্বশেষ তারা মুসলমানদের অতি পবিত্র একটি জায়গা জেরুজালেমেও হাজার হাজার নতুন বাড়ি নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে। মার্কিন সরকারও এর বিরুদ্ধে দৃশ্যত একটি শক্ত অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু তাই বলে ইসরায়েলীরা পরিকল্পনাটা বাতিলও করেনি।

ইহুদীরা ফিলিস্তিনে যা করে চলছে, জেনারেল জিয়াউর রহমানওতো দরিদ্র বাঙালী জনগোষ্ঠীর একটি অংশকে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় বসতি গড়ে তুলতে বাতাস দিয়েছেন প্রত্যৰভাবে। পার্বত্য চট্টগ্রামেও অবস্থাটা এখন এমন যে, ওখানকার আদি চেহারা চরিত্রটাই নষ্ট হয়ে গেছে। ফিলিস্তিনে ইসরাইল যা করে চলেছে আমরা তার ধিক্কার জানাই সরকারীভাবে দেশে বিদেশে, সকল ফোরামে। জিয়াউর রহমানও যখন দেশের ক্ষমতায় ছিলেন, ইসরাইলের নিন্দা তিনিও করেছেন। কিন্তু তিনিই আবার একই জাতের অপরাধটা করলেন পার্বত্য চট্টগ্রামে!!! মোনাফেকী আর কারে কয়? জিয়াউর রহমান যখন এই 'ক্রাইম'টা করলেন তখন দেশের জনসংখ্যা ছিল নয়-দশ কোটি। কয়েক লাখ বাঙালীকে ওখানে নিয়ে বসতি বানিয়ে তিনি তাদের 'ট্রান্সপ্লান্ট' করলেন। কিন্তু তাতে জনসংখ্যার সমস্যাটির কি কোন সমাধান হয়েছে? এখন তো জনসংখ্যা পনের কোটি বা তার চাইতেও বেশি। বা দরিদ্র লোকের সংখ্যাও কি তাতে কমানো গেছে? এখন তো হতদরিদ্র লোকের সংখ্যা ছয় কোটির মতো। জিয়াউর রহমানের এই নীতিটা যদি ভারতীয়রা অনুসরণ করত তাহলে তো কাশ্মীরের চরিত্রটা তারা অনেক আগেই বদলে দিতে পারত।

আর একটি প্রশ্ন আমাদের সম্পাদক সাংবাদিকরা কোনদিন মোহতারেমা খালেদা জিয়াকে করেননি। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ ভারতে হিন্দু ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম করাটা কি মোহতারেমা সমর্থন করবেন? নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, ২০ কোটি মুসলমানের দেশ ভারতে 'হিন্দু ইজ্'কে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করলে, রাতারাতিই এই ২০ কোটি মানুষ দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পর্যবসিত হবে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে হিন্দুধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করাটা যদি 'হারাম' হয়ে থাকে, বাংলাদেশে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে রাখাটা সমর্থনযোগ্য হবে কেন? আর দুনিয়ার কয়টি মুসলমানপ্রধান দেশে ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম?

'সেক্যুলারিজম'-এর বিরুদ্ধে জেহাদ চালিয়ে আসছেন 'আমার দেশ' সম্পাদক 'মরদে মোমিন' মাহমুদুর রহমান, নিজামী-খালেদারা। কিন্তু এই জেহাদীরা জানেন না যে, ফিলিস্তিনেও একটি 'সেক্যুলার' রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষেই তাদের সংগ্রাম চলছে গত ৬০ বছর ধরে। ওখানে 'সেক্যুলার' রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে সমর্থন জানিয়েছেন জেনারেল জিয়া, জেনারেল এরশাদ এবং মোহতারেমা খালেদা জিয়া। এই সেক্যুলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে সমর্থন জানাচ্ছে আমাদের উম্মাহ কওমের 'স্পিরিচুয়েল লিডার সৌদি আরব এবং ইসলামী সম্মেলন সংস্থা ওআইসির ৫৪টি দেশ। ফিলিস্তিনে সেক্যুলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকে মোহতারেমারা দৃঢ় সমর্থন জানাবেন, অথচ বাংলাদেশকে 'সেক্যুলার' চরিত্র দেয়ার বিরুদ্ধে তাদের জেহাদও চলবে। ধান্ধাবাজি, মতলববাজি, মোনাফেকী আর কারে কয়?

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের প্রথম মৌলিক অধিকার জানমালেরও নিরাপত্তা তারা দেবে না; অথচ ইউরোপে মুসলমান মহিলাদের বোরকা পরার অধিকারে সোচ্চার হবে, এই দাবিতে আন্দোলনও করবে!! ধান্ধাবাজরাই এমন একটি 'নীতি'তে বিশ্বাস করে, এই নীতির বাস্তবায়নে মিটিং-মিছিলও করে।

আজ এই লেখার শেষে একটি 'ইন্টারেস্টিং' অভিজ্ঞতা এবং একটি প্রশ্ন। গত ১৪ মে শুক্রবার সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সতীর্থ বন্ধু এবং উত্তরায় প্রতিবেশী আমিনুল ইসলাম বেদুফের রবীন্দ্র একাডেমীর উদ্যোগে আয়োজিত রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকীর একটি অনুষ্ঠানে গেলাম বেদুর দাওয়াতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটম-লে এই সুন্দর অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয়েছিল। একটু আগেই পৌঁছে গিয়েছিলাম বলে হাতে একটু সময় ছিল। হাঁটতে হাঁটতে কবি নজরুলের মাজারের সামনের ফুটপাথে সাজিয়ে রাখা বইগুলো দেখছিলাম। হঠাৎ চোখ পড়ল একটি নামের ওপর, মেহেদী হাসান পলাশ। তারপর দেখলাম তার বইটির নাম 'সংখ্যালঘু রাজনীতি'। প্রচ্ছদে দৈনিক 'মানবজমিন'-এর সৌজন্যে প্রাপ্ত একটি ছবি, সিরাজগঞ্জের স্কুলছাত্রী পূর্ণিমার দুই হাত দিয়ে চোখ ঢেকে রাখা সেই বিখ্যাত ছবিটির একটি বিকৃত সংস্করণ।

এই মেহেদী হাসান পলাশ 'ইনকিলাব' পত্রিকার এক অনন্য 'সৃষ্টি'। ২৯৬ পৃষ্ঠার এই বইটির ভূমিকা লিখেছেন বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং জাতীয়তাবাদী জামায়াতী বুদ্ধিজীবীদের সর্দার অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ। এমাজউদ্দীন এই বইটির প্রচার কামনা করেছেন তার ভূমিকার শেষ বাক্যে। কিন্তু কথা হলো, ইনকিলাবের এই দুর্বৃত্ত সাংবাদিক ২০০১ সালের অক্টোবরের সাধারণ নির্বাচনপরবর্তী হিন্দু সংখ্যালঘুদের টার্গেট করে জাতীয়তাবাদী জামাতীদের পরিচালিত সকল হামলা দাঙ্গা সন্ত্রাস, সবকিছুই অস্বীকার করেছে তার এই বইতে। এই লোকের মতে, পূর্ণিমার ওপর অত্যাচার নির্যাতনের কথাও মিথ্যা, বানোয়াট, সাজানো। তার সোর্সগুলো হলো তখনকার দৈনিক ইনকিলাব, দৈনিক সংগ্রাম এবং দৈনিক দিনকালে প্রকাশিত রিপোর্ট নামের আবর্জনাগুলো। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সাংবাদিকতার একটি অতি নোংরা দিক হলো, কোন একটি পত্রিকায়, আজকালের এই সময়ে মরদে মোমিনের 'আমার দেশ'-এ হলে আরও ভাল, একটি মিথ্যা ছেপে দাও, তারপর সেই রিপোর্টটিকে 'সোর্স' হিসেবে উল্লেখ করে টার্গেটের বিরুদ্ধে মিথ্যার 'ক্যাম্পেইন' চালিয়ে যাও, প্রত্যাশিত লক্ষের কিছুটা হলেও তাতে অর্জিত হবে। দুর্বৃত্ত সাংবাদিক মেহেদী হাসান পলাশও এই নীতিতে বিশ্বাস করে 'গারবেজ' চরিত্রের এই রচনাটি লিখেছে। ইনকিলাব সংগ্রাম এবং দিনকাল কোন চরিত্রের পত্রিকা তা কি এই 'সাংঘাতিক' জানে না? না জেনেই সে সাংবাদিক? 'হরর অব হররস' (Horror of Horrors) এই বইয়ের ভূমিকা লিখে প্রচার কামনা করেছেন সর্দার এমাজউদ্দীন প্রফেসর!!

আজকের শেষ প্রশ্নটি : ধর্মীয় এবং জাতিগত পরিচয়টা যদি বিবেচ্য বিষয় হতো, তাহলে ৬ মের ব্রিটিশ নির্বাচনে এতজন দৰিণ এশীয়, মুসলমান এবং কৃষ্ণাঙ্গরা কি নির্বাচিত হতে পারতেন? মানুষ, মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখলে তখনই সকল মানুষের সকল অধিকার নিশ্চিত হয়।

উত্তরা, ঢাকা, শনিবার, ২২ মে '১০
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
দৈনিক জনকণ্ঠ

1 comment: