রাজধানীতে এক হিন্দু পরিবারের ৯ সদস্য অপহৃত : ৭ ঘন্টা পর উদ্ধার

মাসুম মিজান
পুরান ঢাকার ঋষিকেশ দাস রোড থেকে অপহৃত একই পরিবারের ৯ সদস্যকে গতকাল উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসা হয় (বাঁয়ে); ঘটনাস্খল বাড়িটি দেখতে এলাকাবাসীর ভিড় : নয়া দিগন্ত


ঘটনাস্খল থেকে ক্ষমতাসীন দলের ৪ কর্মী গ্রেফতার


কোনো দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে নয়, কোনো প্রত্যন্ত চর অঞ্চলেও নয়, খোদ রাজধানীতেই চর দখলের মতো ভিটেমাটি দখলের জন্য বৃহস্পতিবার ভোর রাতে অপহরণ করা হয় একই পরিবারের নারী ও শিশুসহ নয় সদস্যকে। তবে অপহৃতদের সৌভাগ্যই বলতে হবে, সূত্রাপুর থানার পুলিশ প্রশংসনীয় দ্রুততার সাথে অপহরণের ৭ ঘন্টার মধ্যেই তাদের সবাইকে অক্ষত অবস্খায় উদ্ধার এবং অপহরণে জড়িত চারজনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছে। অপহৃতরা হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্য এবং গ্রেফতারকৃতরা ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের স্খানীয় শাখার সদস্য বলে জানা গেছে।

অপহৃতরা হলো : বাবুল চন্দ্র দাস মহাবীর (৪৫), তার স্ত্রী লক্ষ্মী দাস (৪৫), তাদের দুই মেয়ে বিউটি (২২) ও সুইটি (১৭), শম্ভু নাথ দাস (৫৫), তার স্ত্রী কাজল রানী দাস (৩৫), তাদের সন্তান সজল (১৫) ও স্বর্ণা (৮) এবং নিতাই চাঁদ দাস (৮৬)।

অপহরণের খবর পেয়ে সূত্রাপুর থানা পুলিশ ঘটনাস্খলে অভিযান চালিয়ে হোসাইন বাবুল, সোহাগ, আক্তার ও নিজাম উদ্দিন সাগর নামে চার হামলাকারীকে গ্রেফতার এবং তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী গতকাল বেলা ১১টায় ৬৫ ঋষিকেশ দাস রোডের জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপে তল্লাশি চালিয়ে একটি বìধ কক্ষ থেকে অপহৃতদের উদ্ধার করে।

শ্বাসরুদ্ধকর ৫ ঘন্টার বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে সম্ভু নাথ দাস নয়া দিগন্তকে জানান, বাবুল ও তিনি আপন দুই ভাই। নিতাই চন্দ্র দাস তাদের চাচাতো ভাই। ৮৬ বছরের এই বৃদ্ধেরও জন্ম হয়েছে শত বছরের পুরনো দোতলা ভবনটিতে। তারও আগে থেকে তাদের পূর্বপুরুষরা বসতি গড়েছেন ওই বাড়িটিতে।

ওই দিনের অপহরণ ও লুটপাটের লোমহর্ষক ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন অপহৃত নারী-শিশু ও পুরুষরা। নয়া দিগন্তের সাথে আলাপকালে তারা জানান, রাত আনুমানিক আড়াইটা থেকে ৩টা হবে। বাড়ির দরজায় সজোরে ধাক্কার আওয়াজ শোনা যায়। নিচতলায় পরিবার নিয়ে বসবাসকারী সম্ভু নাথ দাস ঘরের ভেতর থেকে জানতে চান, কে? জবাবে বাইরে অবস্খানরত ১৫-১৬ ব্যক্তি নিজেদের ডিবি পুলিশ দাবি করে দ্রুত দরজা খুলতে বলে। তা না হলে দরজা ভেঙেই ভেতরে ঢোকার হুমকি দেয় তারা। নিরুপায় সম্ভু নাথ বাধ্য হয়েই দরজা খুলে দেন। পুলিশ পরিচয়দানকারী ১০-১২ জন যুবক ঘরে ঢুকেই সবাইকে মারধর করতে এবং স্টিল আলমারিসহ অন্যান্য স্খানে নগদ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার খুঁজতে শুরু করে। অতর্কিত এ হামলায় হতচকিত সম্ভু নাথ ও তার পরিবারের চারজনের হাত-চোখ বেঁধে মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে দেয়া হয়।

এরপর দোতলার বাবুল চন্দ্র দাসের ঘরে গিয়েও একই কায়দায় মারধর ও লুটপাট করে, পরিবারের চার সদস্যের হাত-চোখ বেঁধে মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে নিচে নামায় হামলাকারীরা। এরই মধ্যে বাবুলের বড় মেয়ের বিয়ের গয়না ও টাকাসহ মোট ২ লক্ষাধিক টাকার মালামাল লুট করা হয়েছে। দুই পরিবারের পাঁচ নারী-শিশুসহ দুই ভাইকে আটকের পর তাদের চাচাতো ভাই বৃদ্ধ নিতাই দাসকেও একই কায়দায় ধরে আনা হয়।

এই সময় অপহরণকারীরা তাদের মারধরও করে। কেউ চিৎকার করলে মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয়। প্রায় এক ঘন্টা ধরে এই দু:সাহসিক হামলার পর তিন পরিবারের সবাইকে (নয়জন) টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় একই রোডের জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের একটি কক্ষে। এ সময় তিন অবিবাহিত মেয়েসহ পাঁচ মহিলার সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করা হয়। বাড়ি লিখে নিতে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেয়ারও অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এ দিকে ঘটনা আঁচ করতে পেরে স্খানীয় কিছু ব্যক্তি সূত্রাপুর থানায় খবর দেন। রাত সাড়ে ৪টার দিকে ঘটনাস্খলে গিয়ে চারজনকে সন্দেহজনক আচরণের জন্য গ্রেফতার করে পুলিশ। খবর পেয়ে ডিএমপি’র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও খুব ভোরেই ছুটে যান ঘটনাস্খল ও সূত্রপুর থানায়।

পুলিশের অব্যাহত জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে গ্রেফতারকৃত ওয়ার্কশপ মালিক হোসাইন মো: বাবুল জানান, অপহৃত নয়জনকে তার ওয়ার্কশপে আটকে রাখা হয়েছে। পরে সেখান থেকে তাদের উদ্ধার করে বেলা ১১টার দিকে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। দীর্ঘ ৫ ঘন্টা হাত-পা, চোখ ও মুখ বেঁধে ফেলে রাখায় সবাই ছিলেন নিস্তেজ। পানি ও খাবার নেই, এমনকি মলমূত্র ত্যাগের সুযোগও দেয়া হয়নি কাউকে। কোনো চিৎকার বা শব্দ করলে গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয় বার বার। তাই অপহৃতরা ধরেই নিয়েছিলেন তাদের মৃত্যু নিশ্চিত। মুখে স্কচটেপ লাগিয়ে দেয়ায় বাঁচার আকুতি জানানোর ক্ষমতাটুকুও ছিল না তাদের।
এ ব্যাপারে ডিএমপি’র ওয়ারী জোনের এডিসি প্রলয় চিসিম নয়া দিগন্তকে বলেন, প্রাথমিক তদন্তে এই অপহরণের সাথে আনন্দধারা হাউজিং লিমিটেড নামে একটি ডেভেলপার প্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। আর উদ্ধারকৃত নয় ব্যক্তিকে তাদের আত্মীয় বিশ্বজিত সাহার জিম্মায় দেয়া হয়েছে এবং তারা সবাই নিজ বাড়িতে যাতে ফিরে যেতে পারেন সে ব্যবস্খাও করেছে পুলিশ।

ঘটনার শিকার সম্ভু ও বাবুল চন্দ্র দাস জানান, তাদের বাড়ির আশপাশের তিনটি প্লট আনন্দধারা হাউজিং লিমিটেডের কাছে হস্তান্তর করেছে প্রতিবেশীরা। এই জমিগুলোর সামনেই তাদের দোতলা পুরনো বিল্ডিং। দীর্ঘদিন থেকে প্রতিবেশীদের মাধ্যমে ওই হাউজিং কোম্পানির কাছে জায়গাটি ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হচ্ছিল। কিন্তু বাপ-দাদার ভিটে-বাড়ি না ছাড়ার পক্ষেই অটল থাকেন ৫ শতাংশ জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত ভবনটির তিন ওয়ারিশ।

মাস দুয়েক আগে স্খানীয় ভূমি অফিসের এক কর্মকর্তা ওই বাড়িতে এসে জানান, বাড়িটির দলিল জনৈক খলিলের নামে চলে গেছে। তার পর থেকেই বাড়ি দখলের পাঁয়তারা শুরু হয়। হুমকি দেয়া হয় পরিবারশুদ্ধ গুম করে ফেলারও। প্রভাবশালী ওই চক্রের বিরুদ্ধে এত দিন মুখ খোলার সাহস পাননি অসহায় হিন্দু পরিবারটি।

সরেজমিন থানা, ঘটনাস্খল ও আনন্দধারা হাউজিং কোম্পানির প্রকল্প স্পট ঘুরেও অভিযুক্ত পক্ষের কারো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে একটি সূত্রের দাবি, আওয়ামী লীগের চিহ্নিত লোকজনই এ ঘটনার হোতা। তাদের আড়াল করতেই সকাল থেকে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেছে এক এমপি’র লোকজন। এমনকি গ্রেফতারকৃতদের ছাড়াতে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার সাথে সূত্রপুর থানা কম্পাউন্ডে ওই এমপি’র পিএকেও দেখা গেছে।

আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের থানায় উপস্খিতির কারণ সম্পর্কে এক ব্যক্তি অভিযোগ করেন, ৮০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা মরহুম দিলশানের তৃতীয় পুত্র হোসাইন মো: বাবুল এ ঘটনায় ঘটনাস্খল থেকে গ্রেফতারকৃতদের একজন। তাকে এক এমপি’র সাথেও মাঝে মাঝে দেখা যায়। আর সোহাগ ও সাগর ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডার হিসেবে এলাকায় সবার কাছে পরিচিত। স্খানীয় বিভিন্ন সূত্র বলেছে, বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই ক্ষমতাসীনদের একাধিক গ্রুপ ওই হিন্দু বাড়িটি দখলের চেষ্টা করে আসছিল।

নয়াদিগন্ত,  ২৩ আগস্ট, ২০০৯

No comments:

Post a Comment