অর্পিত সম্পত্তি আইন বাস্তবায়ন ঝুলে গেল

নতুন করে তালিকা যাচাই শুরু

।। মনির হায়দার ।।

আবারও ঝুলে গেল অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের বাস্তবায়ন। গেজেট আকারে প্রকাশের জন্য সারাদেশের অর্পিত সম্পত্তির যে তালিকা ইতিপূর্বে সরকারি ছাপাখানায় (বিজি প্রেস) পাঠানো হয়েছিল সেগুলো ফিরিয়ে এখন পর্যালোচনা করছে ভূমি মন্ত্রণালয়। যাচাই-বাছাইয়ের জন্য এসব তালিকা ফেরত পাঠানো হচ্ছে প্রত্যেক জেলার ডিসিদের কাছে। এমনকি যাচাই শেষে এ আইনে আরেক দফা সংশোধনী আনা হতে পারে বলেও জানা গেছে। তবে ভূমিমন্ত্রী রেজাউল করিম হীরা ইত্তেফাককে বলেছেন, প্রক্রিয়াগত কারণে কিছুটা সময় লাগলেও অর্পিত সম্পত্তি ইস্যু আর ঝুলিয়ে রাখা হবে না। শত্রু সম্পত্তিকে ঘিরে যুগ যুগ ধরে দেশের লাখো মানুষের জীবনে যে বঞ্চনার করুণ ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে তার অবসানে বর্তমান সরকার বদ্ধপরিকর। প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই শেষে দ্রুততম সময়ে এই আইনের বাস্তবায়ন শুরু হবে। ভূমি সচিব মোঃ দেলোয়ার হোসেনও বলেছেন, আগামী মাস দুইয়েকের মধ্যেই এ আইনের বাস্তবায়ন শুরু হয়ে যাবে।

প্রসঙ্গত, ২০০১ সালের ১১ এপ্রিল জাতীয় সংসদে “অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন ২০০১” নামে একটি নতুন আইন পাস হয়। তখন ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ সরকার। নতুন এ আইনের মাধ্যমে যেসব সম্পত্তি অন্যায়ভাবে শত্রু সম্পত্তি হিসাবে তালিকাভুক্ত হয়েছে সেগুলো প্রকৃত মালিক বা তাদের বৈধ ওয়ারিশদের অনুকূলে ফেরত প্রদান এবং বাকি অর্পিত সম্পত্তিসমূহ চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তির মাধ্যমে দীর্ঘদিনের ঝুলে থাকা সমস্যাটির স্থায়ী সমাধানের কথা বলা হয়। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। কারণ, নতুন এ আইনে বলা হয়েছিল যে, আইনটি কার্যকর হবার পরবর্তী ১৮০ দিনের মধ্যে সরকার সারাদেশের সকল অর্পিত সম্পত্তির তালিকা গেজেট বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ করবে। কিন্তু নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে এ তালিকা প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে ২০০১ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসীন হয়। নতুন সরকার অর্পিত সম্পত্তির তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশের নির্দিষ্ট সময়সীমা তুলে দিয়ে আইনটি সংশোধন করে। মূলত তারপর থেকে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। জোট সরকারের আমলে আইনটি বাস্তবায়নে আর কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

তবে জোট সরকারের শাসনামলের গোড়ার দিকে ৬১টি জেলার ডেপুটি কমিশনারগণ অর্পিত সম্পত্তির যে চূড়ান্ত তালিকা ভূমি মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিলেন, সেই তালিকার ওপর ভিত্তি করে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ আইন বাস্তবায়নে নতুন পদক্ষেপ নেয়। বিদায়ের কয়েকদিন আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গত ২৪ ডিসেম্বর এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন দ্বিতীয় দফা সংশোধন করে। এর ফলে অর্পিত সম্পত্তির চূড়ান্ত তালিকা গেজেট আকারে প্রকাশিত হওয়ার পর এ সম্পর্কিত অভিযোগ বা আবেদন ট্রাইব্যুনালের পাশাপাশি ডেপুটি কমিশনার ও বিভাগীয় কমিশনার পর্যায়েও নিষ্পত্তি করার বিধান রাখা হয়। ২০০১ সালে জাতীয় সংসদে পাস হওয়া অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনে এ সম্পর্কিত অভিযোগ ও দাবি নিষ্পত্তির জন্য শুধুমাত্র ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান রাখা হয়েছিল।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, ২০০১ সালে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন জারির সময় সারাদেশে তালিকাভুক্ত মোট অর্পিত সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ৬ লাখ ৪৩ হাজার ১৪০ একর। এর মধ্যে ১ লাখ ৯৭ হাজার ৪২০ একর অর্পিত সম্পত্তি ইজারা দেয়া ছিল, যা কমবেশি সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে। বাকি ৪ লাখ ৪৫ হাজার ৭২০ একর সম্পত্তি ইজারা বহির্ভূত এবং এসব সম্পত্তি সরকারের দখলে বা নিয়ন্ত্রণে নেই। বিগত কয়েক বছর আইনগত জটিলতা ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের অচলাবস্থার কারণে ইজারা বহির্ভূত অর্পিত সম্পত্তিসমূহ সম্পূর্ণভাবে বেহাত হওয়ার উপক্রম হয়। সেইসাথে বাড়তে থাকে জনগণের ভোগান্তি ও হয়রানি। তাছাড়া ২০০১ সালে আইনটি কার্যকর হবার পর থেকে অর্পিত সম্পত্তির লিজ প্রদান সম্পূর্ণভাবে বন্ধ থাকায় এ খাতে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব থেকেও বঞ্চিত হয় সরকার।

“দ্য ডিফেন্স অব পাকিস্তান অর্ডিন্যান্স ১৯৬৫”-এর ১৬৯ বিধি মোতাবেক তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের যেসব নাগরিক ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তারিখের পূর্ব থেকে ভারতে অবস্থানরত ছিলেন এবং যারা ওই তারিখ হতে ১৯৬৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে ভারতে চলে গিয়েছিলেন তাদের যাবতীয় সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি হিসাবে গণ্য হয়। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে একটি নতুন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সরকার শত্রু সম্পত্তিকে অর্পিত সম্পত্তি হিসাবে অভিহিত করে। এ দুইটি আইনের আলোকে সরকার বিভিন্ন সময় শত্রু সম্পত্তি তালিকাভুক্ত করেছে, দখলে নিয়েছে এবং কিছু কিছু সম্পত্তি চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি করেছে। এ প্রক্রিয়ায় অতীতে বিভিন্ন সময় কোনো কোনো ক্ষেত্রে এদেশে বসবাসকারী নাগরিকদের সম্পত্তিও অন্যায়ভাবে শত্রু সম্পত্তি হিসাবে তালিকাভুক্ত হয়েছে। আবার কিছু অর্পিত সম্পত্তির দখল ও অন্যান্য জটিলতার সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণীর স্বার্থপর ব্যক্তি জাল দলিল সৃজনসহ নানা অজুহাতে আদালতে মোকদ্দমা রুজুর মাধ্যমে সম্পত্তি গ্রাস করার চেষ্টা চালিয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় গত তিন যুগে বেহাত হয়ে গেছে কয়েক লাখ একর অর্পিত সম্পত্তি।

ইত্তেফাক, ১০ এপ্রিল, ১০০৯

3 comments:

  1. Thanks for all these post. Please keep on posting them. It seems that the new government has made some changes but still this goes on.

    Never delete this blog, all the human right activists need this.

    ReplyDelete
  2. দাদাগণ, ঘটনা মনে হয় ভালোই বুঝেছেন। :-D

    ReplyDelete
  3. মনোরঞ্জন5/12/2009 7:55 PM

    এটাই স্বাভাবিক। আমরা আর কিইইবা আশা করতে পারি?

    ReplyDelete