চট্টগ্রামে আতঙ্কে সংখ্যালঘু ভোটাররা সতর্ক আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী

গাজী ফিরোজ শিবলী, চট্টগ্রাম ব্যুরো

চট্টগ্রামে এক হাজার আটজন ভোটারের নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকবেন একজন মাত্র পুলিশ। স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে র‌্যাব ও সেনাসদস্যরা বাইরে থাকলেও ভোটকেন্দ্রে থাকবেন শুধু পুলিশ সদস্যরা। এদিকে সংখ্যালঘু ও সাধারণ ভোটাররা চরম আতঙ্কে মধ্যে রয়েছেন। ভোটারদের ভয়ভীতি দেখাতে এক সংখ্যালঘু পরিবারকে আগুনে পুড়িয়ে মারারও চেষ্টা করা হয়েছে। তাছাড়া পলাতক অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসী এলাকায় ফিরে এসেছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়াতে অনেকে বোরখা পরেও চলাচল করছে।

সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণের জন্য নগরী ও জেলার সব কেন্দ্রে জেলা নির্বাচন কমিশন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রস্তুতি সঙ্কল্প করেছে। ভোটের আগে ও পরে কোনো ধরনের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড এড়াতে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। র‌্যাব, পুলিশ ও সেনাবাহিনীর বোমা ডিসপোজাল টিমও তৎপর রয়েছে। আজ রোববার রাতের মধ্যে ব্যালট পেপার, ব্যালট বক্স এবং পুলিশ ও আনসার সদস্যরা কেন্দ্রে পৌঁছে যাবেন বলে জানা গেছে।

র‌্যাব-৭ চট্টগ্রামের পরিচালক লে. কর্নেল জাহিদুর রহিম সমকালকে বলেন, ঝুঁকিপূর্ণসহ সব ভোটকেন্দ্রে র‌্যাব সদস্যরা স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে কাজ করছে। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে র‌্যাব তৎপর রয়েছে। ভোটাররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে যাতে ভোটকেন্দ্রে আসতে পারে র‌্যাব সে ব্যবস্থা নিয়েছে। একই প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোঃ মনিরুজ্জামান সমকালকে বলেন, ভোটকেন্দ্রে পুলিশের পাশাপাশি আনসার, র‌্যাব ও সেনাবাহিনী তৎপর রয়েছে। ভোটারদের নিরাপত্তার জন্য যা যা করা দরকার সবই করা হয়েছে। সংখ্যালঘুদের ভয়ভীতি ও পলাতক সন্ত্রাসীদের ফিরে আসা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বলেন, এ রকম কোনো খবর আমাদের জানা নেই। কেউ অভিযোগ করলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

চট্টগ্রামের ১৬টি আসনে এবার মোট ভোটার ৪৩ লাখ ৮৮ হাজার ৬১৬ জন। ভোটারদের নিরাপত্তায় থাকবে ৪ হাজার ৩৫২ জন পুলিশ। এ হিসাবে এক হাজার আটজন ভোটারের জন্য থাকবে মাত্র একজন করে পুলিশ। ভোটকেন্দ্রের বাইরে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে সেনাবাহিনী ও র‌্যাব। নগরীর ১৬টি আসনে দেড় শ’র মতো র‌্যাব সদস্য টহল দিচ্ছেন। সেনাবাহিনীর সহস্রাধিক সদস্য বিভিন্ন জায়গায় ক্যাম্প স্থাপন করে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে টহল দিচ্ছেন।

জানা গেছে, চট্টগ্রামে নয় লাখের মতো সংখ্যালঘু ভোটার রয়েছে। প্রতিটি আসনেই আছে অনেক সংখ্যালঘু ভোটার। কিছু কিছু এলাকায় সংখ্যালঘু ভোটাররা ফলাফল নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখে। এটিই তাদের জন্য কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবার এক হাজার ৭৮৫টি ভোটকেন্দ্রে সংখ্যালঘু ভোটারদের ভোট দেওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু চারদলীয় জোটপ্রার্থী সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর নির্বাচনী এলাকা ফটিকছড়ি, রাঙ্গুনিয়া, হুইপ ওয়াহিদের হাটহাজারী, গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রাউজান, নগরীর কোতোয়ালি, বোয়ালখালী, চন্দনাইশ, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া এলাকায় সংখ্যালঘু ও সাধারণ ভোটাররা আতঙ্কে রয়েছেন। ‘ভোট পেয়ে গেছি’, ‘হিন্দুদের ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার দরকার নেই’, ‘ফলাফল উল্টো হলে দেখে নেওয়া হবে’ বলেও শাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সীতাকুণ্ডের কুমিরা, লতিফপুর, ইমামনগর, সৈয়দপুর, চন্দনাইশে হুমকি-ধমকি দেওয়ার পর প্রশাসনের হস্তক্ষেপ চেয়েছে ভোটাররা। গত ২২ ডিসেম্বর চন্দনাইশের বরমা ইউনিয়নের মাইগাতা গ্রামের হিন্দুপাড়ায় একটি সংখ্যালঘু দিনমজুর পরিবারের সদস্যদের ঘুমন্ত অবস্থায় পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করা হয়। দুর্বৃত্তরা ননী গোপাল দের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন দেওয়ার আগে দরজায় তালাও লাগিয়ে দেয়। পরিবারের এক সদস্য সঙ্গে সঙ্গে আগুন দেখতে পাওয়ায় বেঁচে যায় তারা। এ ঘটনায় তপন দে বাদী হয়ে চন্দনাইশ থানায় মামলা দায়ের করেছেন।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত সমকালকে বলেন, ‘সংখ্যালঘু ভোটারদের নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে, যাতে তারা ভোটকেন্দ্রে না যায়। আমরা একটি সেল খুলেছি। সেলে প্রতিদিনই সংখ্যালঘু ভোটারদের হুমকি-ধমকি দেওয়ার খবর আসছে। স্থানীয় প্রশাসন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের পর্যবেক্ষণ টিমের সঙ্গে বৈঠকেও বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। এরপরও ভোটারদের আতঙ্ক কাটছে না। প্রশাসন যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে ২০০১ সালের মতো নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটতে পারে।’

ওয়ান ইলেভেনের পর বিদেশে পালিয়ে যাওয়া সন্ত্রাসীরাও এলাকায় ফিরে আসছে। ভারত হয়ে রামগড় সীমান্ত দিয়ে কয়েকদিন আগে দেশে ফিরেছে ১০ সন্ত্রাসী। এদের মধ্যে ছাত্রদল ক্যাডার নগরীর শীর্ষ সন্ত্রাসী মোরশেদ খান, রাউজানের বিধান বড়ূয়া ও আজিম উদ্দিন উল্লেখযোগ্য। মোরশেদ খান ও আজিম উদ্দিন বোরকা পরে চলাচল করছে। সাধারণ ভোটারদের হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। এ ব্যাপারে সহকারী পুলিশ কমিশনার (কোতোয়ালি জোন) বাবুল আখতার সমকালকে বলেন, ‘বোরকা পরে অনেক সন্ত্রাসী পুলিশের চোখ ফাঁকি দিচ্ছে। বেশ কয়েকবার অভিযান চালালেও পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় তারা। আশা করি, তাদের গ্রেফতার করতে পারব।’
জানা যায়, ১৬টি আসনে ১ হাজার ৭৮৫টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে সহস্রাধিক কেন্দ্রকে পুলিশ গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। গুরুত্বপূর্ণ ভোটকেন্দ্রগুলোতে একজন উপপরিদর্শক ও চারজন করে কনস্টেবল থাকবে। ভোটকেন্দ্রের ছাদের ওপর অস্ত্রধারী পুলিশ থাকবে নিরাপত্তায়।

এছাড়া পুলিশের ৮০টি মোবাইল টিম থাকবে। প্রতি টিমে ৫ জন করে পুলিশ থাকবে। পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশের টিম নগরীর চেকপোস্ট ও ভোটকেন্দ্রগুলোতে নজরদারি রাখবে। ৫০ প্লাটুন বিডিআর এর স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে থাকার কথা রয়েছে। ভোটকেন্দ্রে পুলিশের পাশাপাশি নগরীর ৫৬০টি ভোটকেন্দ্রে ৬ হাজার ৭২০ জন আনসার ভিডিপি সদস্য, জেলার ১৪টি উপজেলায় ১ হাজার ২৫৭টি ভোটকেন্দ্রে ১৫ হাজার ৮৪ জন সদস্য ভোটকেন্দ্রের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত থাকবেন। এছাড়া অন্যান্য মোবাইল/স্ট্রাইকিং ফোর্সের সঙ্গে চট্টগ্রামসহ প্রতিটি জেলায় ব্যাটালিয়ন আনসারের দুটি মোবাইল টিমও মোতায়েন থাকবে।

এদিকে ১৬টি আসনে নির্বাচন সম্পন্ন করতে জেলা নির্বাচন কমিশন ৩৫ হাজার পোলিং ও প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে। মহানগরী ও জেলা পর্যায়ে দুই পর্বে পোলিং-প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। ১৬ হাজার স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স নির্বাচন কমিশনে এসে পৌঁছেছে। জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা দুলাল তালুকদার সমকালকে বলেন, ‘নির্বাচনের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। আশা করি সুষ্ঠুভাবে ভোট সম্পন্ন হবে।’

চট্টগ্রাম-৮ আসনে সংখ্যালঘুদের হুমকির অভিযোগ

চট্টগ্রাম-৮ (কোতোয়ালি) আসনে সংখ্যালঘু ও সাধারণ ভোটারদের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে। গতকাল শনিবার সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে মহাজোট প্রার্থী নুরুল ইসলাম বিএসসি এ অভিযোগ করেন। অভিযোগ করা হয়, চারদলীয় জোট প্রার্থী ও তাদের নেতা-কর্মীরা সংখ্যালঘুদের ভোটকেন্দ্রে না আসতে নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে। টেরিবাজার এলাকায় এক সংখ্যালঘু দোকানদারকে দোকানে না আসতেও হুমকি দেওয়া হয়। তাছাড়া আচরণবিধি লঙ্ঘন করে ভোটারদের টাকাসহ বিভিন্ন উপহার দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন মহাজোট প্রার্থী। মতবিনিময় সভায় উপস্থিত ছিলেন সাবেক মন্ত্রী এমএ মান্নান, মানবাধিকার সংগঠক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত, মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা নঈম উদ্দিন চৌধুরী, আজম নাছির, শ্রমিক নেতা মুহাম্মদ শুক্কুর আলী, শহীদুল্লাহ চৌধুরী প্রমুখ।

সমকাল, ২৮ ডিসেম্বর, ২০০৮

No comments:

Post a Comment