সাকাচৌর তান্ডব, ভোটদানে বাধা, সংখ্যালঘুর বাড়িতে আগুন

একরামুল হক বুলবুল, প্রণব বল ও মো. ইব্রাহিম খলিল, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) ও চট্টগ্রাম-৬ (রাঙ্গুনিয়া, বোয়ালখালী আংশিক) নির্বাচনী আসনে চারদলীয় জোটের প্রার্থী সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর ক্যাডাররা গতকাল বিভিন্ন কায়দায় সহিংসতার চেষ্টা চালায় এবং ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। সংখ্যালঘু ভোটারদের তারা ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেয়।

ফটিকছড়িতে নির্বাচনের আগের রাতে একটি সংখ্যালঘু পরিবারের বাড়িতে আগুন দিয়ে ওই এলাকায় সংখ্যালঘুদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ানোর চেষ্টা হয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই দুটি আসনেই চার দলের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সাকা চৌধুরী। ভোট গ্রহণ বন্ধ রাখা এবং ভোটার ও সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনা এবং ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটায় এই দুই আসনের বিভিন্ন কেন্দ্রে নির্ধারিত সময় বিকেল চারটার পরও প্রায় দুই ঘণ্টা বেশি সময় ধরে ভোট গ্রহণ করা হয়।

গতকাল সরেজমিন ঘুরে রাঙ্গুনিয়ার সোনারগাঁও, দক্ষিণ রাজানগরের রাজভুবন, রফিকাবাদ স্কুল, লালানগর হাইস্কুলসহ বিভিন্ন কেন্দ্রে সংখ্যালঘু ভোটারদের বাধা দিতে দেখা গেছে। এলাকাবাসী এসব ঘটনার জন্য চারদলীয় জোটের প্রার্থী সাকা চৌধুরীর অনুসারীদের দায়ী করেছে। সেনাবাহিনীর টহল থাকায় ও পুলিশের তৎপরতার কারণে অনেক সংখ্যালঘু ভোটার পরে কেন্দ্রে যেতে সাহস পান।

স্থানীয় ভোটারদের অভিযোগ, রহস্যজনক কারণে সোনারগাঁও কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ কয়েক ঘণ্টার জন্য বন্ধ রাখা হয়। এই কেন্দ্রের বাইরে গোলযোগ করে সংখ্যালঘুদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টির অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভোট গ্রহণ বন্ধ থাকায় সেনাবাহিনীর টহল দল ও পুলিশ পরিবেশ সৃষ্টি করে ভোটারদের আবার কেন্দ্রে যাওয়ার সুযোগ করে দেন, যে কারণে গতকাল সন্ধ্যা ছয়টা নাগাদ ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়।

প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আবদুল কাইয়ুম অবশ্য ভোট গ্রহণ বন্ধ রাখার অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, কেন্দ্রের বাইরে গন্ডগোল হয়েছে। এ কারণে ভোটারদের কেন্দ্রে আসতে দেরি হয়। ওই ভোটারদের ভোট নিতে সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়।

লালানগর স্কুল কেন্দ্রের অদুরে তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ও সাকা চৌধুরীর ক্যাডার বখতেয়ার সংখ্যালঘুদের কেন্দ্রে যেতে বাধা দেন। এ কারণে চারদলীয় জোট ও মহাজোটের সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরে সেনাবাহিনীর টহল দল এলে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়।

চন্দ্রঘোনা ইউপি চেয়ারম্যান ইদ্রিছ আজগর জানান, চন্দ্রঘোনা-কদমতলি ইউনিয়নের কদমতলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ শুরুর পর সাকা চৌধুরীর ক্যাডার হাজি ইলু ও তাঁর সহযোগীরা মিনারপাড়ার হিন্দু ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেয়। ফলে মিনার পাড়ার নারী ভোটারদের অনেকে ভোট দিতে পারেননি।

মরিয়মনগর ইউপি সদস্য কামাল উদ্দিন জানান, সাকা চৌধুরীর ক্যাডার ফজল হক, নুরুল আজিম, উল্টা আইয়ুবসহ চিহ্নিত ক্যাডাররা মরিয়মনগর ইউনিয়ন পরিষদ কেন্দ্রে ভোটারদের ধানের শীষে ভোট দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলে পৌঁছালে ক্যাডাররা পালিয়ে যায়।
সরফভাটা ইউপির মধ্যম সরফভাটা গ্রামের নাজিম উদ্দিন জানান, সরফভাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং সরফভাটা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে সাকা চৌধুরীর ক্যাডার রেড করিম ও তার সহযোগী এবং তিনপাড়া ঐক্য পরিষদের সোহেল, জালাল, ইউনুছ ও সবুজের নেতৃত্বে মহাজোটের প্রার্থীর নির্বাচনী ক্যাম্পে হামলা চালায়। এ সময় ভোট দিতে আসা নারী ভোটাররা ভয়ে ভোট না দিয়ে ঘরে ফিরে যান।

ওই কেন্দ্রের সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা দুলাল কান্তি শীল প্রথম আলোকে বলেন, হামলার কারণে প্রায় দেড় ঘণ্টা কেন্দ্রের নারী বুথগুলো ফাঁকা ছিল। পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অবস্থান নিয়ে নারী ভোটারদের ভোট দিতে সহায়তা করে।

লালানগর ইউপি সদস্য দুলাল দাশ জানান, লালানগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের কুলালপাড়া গ্রামের হিন্দু ভোটারদের কেন্দ্রে যাওয়ার সময় কুলালপাড়া রাস্তার মাথায় সাকার ক্যাডার বখতেয়ার বাহিনীর প্রধান বখতেয়ার বাধা সৃষ্টি করেন। এমনকি মারধর করে ১০-১২ জন ভোটারকে ফিরিয়ে দেয়। ফলে অনেক হিন্দু ভোটার ভোট দিতে পারেনি। একইভাবে ক্যাডারদের বাধার সম্মুখীন হয়েছে হোসনাবাদ ইউনিয়নের খীলমোগল উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্র, নিচিন্তাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র, চন্দ্রঘোনা জেসি দাশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র, সরফভাটা মীরের খীল উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে সংখ্যালঘু ও আদিবাসী ভোটাররা ভোট দিতে বাধা পান বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

দক্ষিণ রাজানগর ইউনিয়নের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম জানান, সকাল নয়টায় রাজাভুবন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে সাকা চৌধুরীর ক্যাডাররা নারী ভোটারদের ভোট দিতে বাধা সৃষ্টি করে। প্রতিবাদ করায় ইউপি চেয়ারম্যান এনামুল হক মিয়াকে মারধর করার চেষ্টা করে ক্যাডাররা।

রাঙ্গুনিয়ায় মহাজোটের প্রার্থী ড. হাসান মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, "আমার প্রতিপক্ষ আগের কায়দায় ভোটারদের ভয়ভীতি দেখিয়েছে। ফলে অনেকে ভোট দিতে পারেনি।"

ফটিকছড়ি: গত রোববার রাত তিনটার দিকে ফটিকছড়ির নানুপুর ইউনিয়নের নানুপুর পশ্চিম বড়ুয়াপাড়ার একটি বাড়ি ও তিনটি খড়ের গাদায় একই সঙ্গে আগুন দেয় কিছু দুর্বৃত্ত। সকাল ১০টায় বড়ুয়াপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, নীলকমল বড়ুয়া, দীপক বড়ুয়া ও পুলিনী বিহারী বড়ুয়ার তিনটি ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। কিন্তু খড়ের গাদায় তখনো আগুন জ্বলছিল। আগুনে "আনন্দ ধাম" নামে একটি বৌদ্ধ প্যাগোডার লাগোয়া ভিক্ষু বিমল জ্যোতির নিবাসটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

কেন্দ্রে যাওয়ার সময় অর্পণ বড়ুয়া, লিটন ও স্বপনকে মারধরও করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। আগুনের ঘটনা প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ প্রার্থী এ টি এম পেয়ারুল ইসলাম বলেন, "সাকা চৌধুরীর সন্ত্রাসীরা আগুন দিয়েছে। সংখ্যালঘুরা যাতে ভোটকেন্দ্রে না আসে সে কারণে এই ঘটনা ঘটেছে।" পাল্টা অভিযোগ করেছেন প্রতিদ্বন্দ্বী সাকা চৌধুরী। বড়ুয়াপাড়ায় সাকার ক্যাডারদের আগুন দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তাঁর প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট মো. সালাহউদ্দিন।

দুপুর সোয়া দুইটার দিকে ফটিকছড়ি আতরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে অনিয়মের অভিযোগ প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ফজলুল হককে লাঞ্ছিত করেছে কিছু উচ্ছৃঙ্খল যুবক। পরে এই খবর পেয়ে সেনাসদস্য ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত হয়ে নিয়ন্ত্রণে আনেন।

প্রথম আলো, ৩০ ডিসেম্বর, ২০০৮

No comments:

Post a Comment