সংখ্যালঘুরা ছিল শংকামুক্ত

।। ইত্তেফাক রিপোর্ট ।।

সারাদেশে এবার সংখ্যালঘু ভোটাররা শংকামুক্তভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে ভোট গ্রহণের ৬ ঘন্টা আগে একটি বৌদ্ধ মন্দির আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়ার ঘটনা ছাড়া আর কোন অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। বরিশালের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে এবার ছিল আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী সংস্থার কড়া নজরদারি। প্রসঙ্গতঃ ২০০১ সালের নির্বাচনের পরে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংখ্যালঘুদের জমি দখল ও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছিল। সেই প্রেক্ষাপটে এবারও ভোটের আগে সংখ্যালঘুদের মধ্যে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছিল।

বরিশাল অফিস থেকে লিটন বাশার জানান, সংখ্যালঘু ভোটারদের মাঝে কোন আতংক নেই। গত নির্বাচনে পহেলা অক্টোবর রাতেই সংখ্যালঘু অধ্যুষিত গৌরনদী-আগৈলঝাড়া, উজিরপুর, চরমোনাই, ভোলার লালমোহন-তজুমদ্দিন ও দৌলতখানে সংখ্যালঘু পরিবারের উপর বর্বরোচিত হামলার ঘটনা ঘটে। এবার শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ায় সংখ্যালঘু ভোটাররা পুনরায় হামলার আশংকা করছেন না। গৌরনদীর বাকাই সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রে কথা হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতা নিরঞ্জন দত্তের সাথে। তিনি জানান, গত নির্বাচনের পরপরই নিখিল ঠাকুরের বাড়িতে হামলা চালানো হয়। তারা বাড়িঘর দখলে রেখে এক বছর ধরে পুকুরের মাছ ও বাগানের গাছ কেটে বিক্রি করে। গৌরনদী উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক বাবুল দত্ত জানান, হিন্দু পরিবারের নিরাপত্তায় তারা গৌরনদী-আগৈলঝাড়ায় পাহারা বসিয়েছেন। ভোটের পূর্ব রাতে উপজেলা জামায়াতের আমীর টাকা নিয়ে ভোট কিনতে গিয়ে বাধাপ্রাপ্ত হন। হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় তারা কাউকে ঢুকতে দিচ্ছেন না। সংখ্যালঘু পরিবারগুলোর সাথে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে পাহারা অব্যাহত রেখেছে। এবার হামলা হলে তারা পাল্টা জবাব দিবেন বলে সংখ্যালঘু নেতারা জানিয়েছেন। খাঞ্জাপুর, চাঁদশী ও বার্থীর সংখ্যালঘু ভোটাররা এখনো সেই দৃশ্য ভুলতে পারেননি। এবার আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি ভাল। মেধাকুল এলাকার হিন্দু ভোটাররা নির্ভয়ে ভোট প্রদান করেছেন। ঐ গ্রামের গৃহবধূ মৃণালীনী জানান, গত নির্বাচনের পর সুধীর বৈরাগীর বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটে। সতীশের উপর সন্ত্রাসীরা বোমা হামলা চালায়। তিনি প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছিলেন একটি পুকুরে। সেখানেও তাকে মারধর করা হয়। ঐ হামলায় নিহত হয়েছিল এক সংখ্যালঘু ব্যক্তি। এবার নির্বাচনের আগেই পুলিশ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গৌরনদী-আগৈলঝাড়া ও উজিরপুর এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে একাধিক বৈঠক করেন। ভোলার পুলিশ সুপার লালমোহন গিয়ে ভোটারদের আশ্বস্ত করেন। বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি খান সাঈদ হাসান জানান, হিন্দু সম্প্রদায়কে সকল প্রকার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। নির্বাচনের পরও পুলিশের টহল সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় জোরদার রয়েছে বলে তিনি জানান।

কেরানীগঞ্জ ঘুরে এসে আমাদের স্টাফ রিপোর্টার মোহাম্মদ আবু তালেব জানিয়েছেন, সকল সংশয় ও আশঙ্কা কাটিয়ে কেরানীগঞ্জের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হাজার হাজার ভোটার নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন। ভোটারদের অনেকেই জানিয়েছেন, স্বাধীনতার পর এই প্রথমবারের মতো তারা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারলেন। হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে পরিচিত কেরানীগঞ্জের বাঘৈর, বীর বাঘৈর, শুভাড্যা, আইন্ডা, পূর্বাদি, ব্রাহ্মণগাঁও, বনগ্রাম, তেঘরিয়া, কাজিরগাঁও, কাঠুরিয়া, দীঘিরপাড়সহ বিভিন্ন এলাকার সংখ্যালঘু পরিবারগুলোর হাজার হাজার ভোটার সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেন। বনগ্রামের বৃদ্ধা বিশাখাঁ রানী দাস জানান, সত্তরের নির্বাচনের পর এই প্রথম তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা প্রশাসনের সহায়তায় পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন। বাঘৈর কেন্দ্রের সুনীল চন্দ্র দাস জানান, এবার তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পেরেছেন।

সিলেট অফিস থেকে ফখরুল ইসলাম জানান, সিলেট বিভাগের ১৯টি আসনেই সোমবার নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আদিবাসীসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোটাররাও নির্ভয়ে ও নির্বিঘেœ ভোট দিয়েছেন। গতকাল সন্ধ্যা ৭টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বিভাগের কোথায়ও সংখ্যালঘু ইস্যু নিয়ে বড় ধরনের কোন নির্বাচনী সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি। সিলেটের বিভিন্ন কেন্দ্রে সংখ্যালঘু ভোটারদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এবার চাপ কিংবা ভয়-ভীতি ছাড়াই তারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। আনন্দ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তারা নিজের পছন্দমতো প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন।

সিলেট-১ আসনের শিবগঞ্জের নবীনচন্দ্র সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোটদান শেষে গৃহিণী শিপ্রা তালুকদার বলেন, খুব আগ্রহ নিয়ে এবার ভোট দিয়েছি। নির্বাচনী পরিবেশও ভালো লেগেছে। কোন চাপ কিংবা ভয়-ভীতি ছিল না। আমাদের সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলা সংবাদদাতারাও জানান, ঐসব জেলায়ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন নির্বিঘেœ ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন।

খুলনা অফিস থেকে রেজাউল করিম জানান, এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনা ও বাগেরহাটের সংখ্যালঘু ভোটাররা অন্যবারের তুলনায় নির্বিঘ্নে ভোট প্রদান করেছেন। এবার তাদের উপর ছিল না কোন প্রার্থী কিংবা তাদের দলীয় নেতা-কর্মী-সমর্থকদের চাপ। ভোট কেন্দ্রে আসার সময় ছিল না কোন শঙ্কা। তারা সবাই নিঃসঙ্কোচে ভোট কেন্দ্রে এসে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছে।

খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলার সাচিবুনিয়া কেন্দ্রে ভোট দিতে আসা ঝাড়ডাঙ্গা গ্রামের সুজিৎ গোলদার (৬১) জানান, এবার নির্বাচন নিয়ে কোন ধরনের ভয় কিংবা চাপের মুখে পড়তে হয়নি। নির্বিঘ্নে তিনি বাড়ি থেকে কেন্দ্রে এসে ভোট দিয়েছেন। একই কেন্দ্রে ভোট দিতে আসা বড়ঘরিয়া গ্রামের অমল বিশ্বাস (৫০) বলেন, অতীতে ভোটকক্ষের মধ্যেও অনেক প্রার্থীর লোকজন অবাধে ঘোরাফেরা করতো। কিন্তু এবার তা হয়নি। ডুমুরিয়ার শোভনা ভোট কেন্দ্রে আসা বিষ্ণু মল্লিক (৪৫) জানান, এবার শান্তিমত ভোট দিতে পেরেছি।

দৈনিক ইত্তেফাক, ৩০ ডিসেম্বর, ২০০৮

No comments:

Post a Comment