ভোটের আগেই হুমকি ধমকি, আতঙ্কে সংখ্যালঘুরা

জনকণ্ঠ ডেস্ক।।
গত সংসদ নির্বাচনের ন্যায় এবারও দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। নির্বঅচনের দিন ভোটকেন্দ্রে যাওয়া ও নিরাপদে ভোট দিতে পারবেন কিনা এ নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন তাঁরা। ইতোমধ্যে চাঁদপুরের কচুয়া, শরীয়তপুর, মানিকগঞ্জ ও টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের নানা হুমকি ধমকির মধ্যে নিরাপত্তাহীনতায় ভোগার খবর পাওয়া গেছে। কচুয়ার একটি রাজনৈতিক দলের প্রতীকে ভোট দেয়ার জন্য সংখ্যালঘু নারী-পুরুষদের শাসানো হচ্ছে। শরীয়তপুরের বিভিন্ন এলাকায় নিষিদ্ধঘোষিত পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির সশস্ত্র ক্যাডার তৎপর হয়ে উঠেছে। তারা একটি মার্কায় ভোট দেয়ার জন্য এলাকাবাসীকে হুমকি ধমকি দিচ্ছে। মানিকগঞ্জ-১ আসন ও টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যরাও একই ধরণের আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। খবর নিজস্ব সংবাদদাতাদের।

কচুয়ায় নিরীহ ভোটারদের প্রভাবান্বিত করা হচ্ছে। অন্যথায় তাদের ঘর পুড়িয়ে বাড়িছাড়া করা হবে বলে হুমকি দেয়া হচ্ছে। কচুয়ার প্রত্যন্ত এলাকা ঘুরে এবং সংখ্যালঘুদের সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাঁদপুর-১ কচুয়া নির্বাচনী এলকায় প্রায় অর্ধ লাখ সংখ্যালঘু ভোট রয়েছে। এদের নিশ্চিত ভোটপ্রয়োগের ওপরই ওই এলাকার জয়-পরাজয় নির্ভর করে। গত '৯৬ এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে একটি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দলের পাণ্ডাদের ভয়-ভীতির কারণে সিংহভাগ সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ভোট কেন্দ্রে যেতে পারেনি। যারাই ভোটকেন্দ্রে গিয়েছে নির্বাচনের পর তাদের ওপর চলেছিল বর্বর নির্যাতন। বাড়িঘর পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। সুন্দরী যুবতী ও নারীরা নিজ বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছিল। অনেকে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। কেউ কেউ আত্মাহুতি দিয়েছে। অনেক সংখ্যালঘু পুরুষ সন্ত্রাসী পাণ্ডাদের বিপুল অঙ্কের চাঁদা (টাকা) দিয়ে নিজ ও পরিবারকে বাঁচিয়েছে। মহিলাদের ধর্মীয় বিধি শাঁখা খুলে ও সিঁদুর মুছে চলাফেরা করতে হয়েছিল।

ওই সময়ে বিশেষ করে ২০০১ সালের নির্বাচনের পর ক্ষমতালোভী ওই সন্ত্রাসী-পাণ্ডাদের কথা মনে পড়লে এখনও আঁতকে ওঠেন ওই এলাকার নির্যাতনের শিকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েক সংখ্যালঘু মহিলা-পুরুষ জানালেন গত কয়েকদিন যাবত কিছু যুবক পাড়ায় পাড়ায় ঢুকে ধানের শীষে ভোট দেয়ার জন্য টাকা দিচ্ছে। যাওয়ার সময় ওইসব যুবক ধানের শীষে ভোট না দিলে আগের মতো ভয়াবহ পরিণতির শিকার হতে হবে বলে শাসিয়ে যায়। এমনি অবস্থায় আতঙ্কে রয়েছে কচুয়ার সাচার, ডেউতয়া, নাহারা, ঘাগড়া, ডুমুরিয়া, বাড়ৈয়া, মাছিমপুর, মাঝিগাছা, নিশ্চিন্তপুর, গোবিন্দপুর, পাথৈর, আকানিয়া, হোসেনপুর, শ্রীরামপুর, পালগিরি, সেংগুয়া, গোহাট, কোটোবাসহ বিভিন্ন গ্রামের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন। তাদের অনেকেই ভাবছেন ভোটকেন্দ্রে যাবেন কিনা। গেলে আগের মতো ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হতে হবে কিনা। এ নিয়ে তাদের মধ্যে রয়েছে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা।

এ ব্যাপারে চাঁদপুর-১ আসন কচুয়া আওয়ামী লীগ ও মহাজোট প্রার্থী সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীরের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা ও নৌকার বিজয় সুনিশ্চিত জেনে ক্ষমতালোভী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি এবারও সেই উন্মাদনায় মেতে উঠেছে। তারা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও নিরীহ ভোটারদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছে। তারা যাতে ভোটকেন্দ্রে ভোট দিতে যেতে না পারে। তিনি এজন্য প্রতিপক্ষ বিএনপির সন্ত্রাসী কার্যকলাপকে দায়ী করেন। এদিকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সহ সাধারণ মানুষ যাতে নির্ভয়ে ভোটকেন্দ্রে যেতে পারে এবং নির্বাচন পরবর্তী সময়ে মানুষ যাতে নির্বিঘ্নে বাড়িঘরে থাকতে পারে তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ করবে বলে ভুক্তভোগী ও সাধারণ মানুষ মনে করেন।

'বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হবে, ঘরছাড়া করা হবে।। কচুয়া শরীয়তপুর মানিকগঞ্জ মির্জাপুর'

শরীয়তপুর-১ ও ৩ নির্বাচনী এলাকায় পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টির ক্যাডাররা হামলে পড়েছে। ফলে এসব এলাকার সংখ্যালঘুসহ সাধারণ ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে সঠিকভাবেতাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারবে কি না সে বিষয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছে।

জানা গেছে, ভেদরগঞ্জ উপজেলার ছয়গাঁও গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক ভূইয়ার ছেলে সর্বহারা পার্টির আঞ্চলিক কমাণ্ডার মোস্তফা ভূইয়া ওরফে হাদী (পার্টিগত পরিচিতি নাম হাদী)। তাঁর সহযোগীদের নিয়ে গত কয়েক দিন যাবত নিজ এলাকায় অবস্থান করে শরীয়তপুর-৩ আসনের বিএনপিদলীয় প্রার্থী কেএম হেমায়েত উল্লাহ (আওরঙ্গজেব) এর পক্ষে ভোট চাচ্ছে। উক্ত সর্বহারা নেতা ভেদরগঞ্জ উপজেলার ছত্রপুড়িয়া, সিংগাচুড়া, নাজিমপুর, গাংসার, কাজলকোর্ট, পমলাকার্ত্তা, পাপরাইল ও মহিষার গ্রামে গিয়ে ভোটারদের হুমকি দিয়ে বলেছে যে, ধানের শীষে ভোট না দিলে এলাকাছাড়া করা হবে। এসব অভিযোগ এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে। সর্বহারা পার্টির নেতা মোস্তফা ভূইয়ার আপন ছোট ভাই জেএমবি নেতা কামরুজ্জামান স্বপন ভূইয়া বিগত ১৭ আগস্টের বোমা হামলার চার্জশীটভূক্ত আসামি হিসেবে জেল হাজতে আছে। শরীয়তপুর-৩ আসনের মহাজোট প্রার্থী আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রাজ্জাক। এ আসনে সংখ্যালঘু ভোটারের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। এরা সচরাচর নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে থাকে। এলাকাবাসী জানান, পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ সিরাজ সিকদারের গ্রামের বাড়ি ভেদরগঞ্জ উপজেলার ছয়গাঁও ইউনিয়নের লাকার্ত্তা গ্রামে। শহীদ সিরাজ সিকদারের আপন ছোট ভাই শহীদুল হক লিটু সিকদার এবার শরীয়তপুর-১ আসন থেকে বিএনপিদলীয় প্রার্থী হয়েছেন। সেই সুবাদে এ অঞ্চলের নিষিদ্ধ ঘোষিত পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টির নেতাকর্মীরা বিএনপিদলীয় প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে নেমেছে বলে এলাকাবাসী ধারণা করছে। এ ব্যাপারে শহীদুল হক লিটু সিকদারের কাছে জানতে চাইলে তিনি কিছুটা বিরক্ত হয়ে মোবাইলের লাইন কেটে দেন। শরীয়তপুর-৩ আসনের অপর বিএনপিদলীয় প্রার্থী কেএম হেমায়েত উল্লাহর (আওরঙ্গজেব) ছোট ভাই শহীদ খান জানান, সর্বহারা পার্টির কোন নেতাকর্মীকে তারা চেনেন না।

মানিকগঞ্জ-১ আসনের তেরশ্রী গ্রামের সংখ্যালঘুরা এবারও পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবে কি না কিংবা আদৌ ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবে কিনা তা নিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত। ভোটের আগে প্রতি বারের মতো এবারও তাদের নির্দিষ্ট মার্কায় ভোট দিতে হুমকি ধামকি দেয়া হচ্ছে। সাধারণ সংখ্যালঘুরা এতটাই সন্ত্রস্ত যে তারা মুখ খুলতেও রাজি হয়নি। তবে স্থানীয় হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে প্রশাসনের কাছে বাড়তি নিরাপত্তার দাবি জানিয়েছে।

মানিকগঞ্জ-১ আসনের ঘিওর উপজেলার পয়লা ইউনিয়নের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত তেরশ্রী গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা চালিয়েছিল স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাক হানাদার বাহিনী। পয়লা ইউনিয়ন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি অবশ্য হুমকির কথা স্বীকার বলে বলেন, প্রতি নির্বাচনের আগেই সংখ্যালঘুদের ওপর এভাবে চাপ সৃষ্টি করা হয়। যে কারণে সংখ্যালঘুরা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারে না। অথবা তারা ভোট দিতে কেন্দ্রেই যায় না। তিনি বলেন, এবারও সেই অবস্থার সৃষ্টি করা হচ্ছে। তিনি তেরশ্রী গ্রামের নিরাপত্তার জন্য দাবি করেছেন।

টাঙ্গাইল-৭ (মির্জাপুর) আসনের বিএনপি মনোনীত চারদলীয় জোট প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ সিদ্দিকীর কর্মীরা সংখ্যালঘু ভোটারদের ভয়ভীতি ও হুমকি প্রদান করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ব্যাপারে এ আসনের আওয়ামী লীগের মনোনীত মহাজোট প্রার্থী একাব্বর হোসেনের নির্বাচন পরিকল্পনা কমিটির আহ্বায়ক এ্যাডভোকেট বাদশা মিয়া মঙ্গলবার রাতে মির্জাপুর ইউএনও এবং সহকারী রিটার্নিং অফিসার মোঃ নিজাম উদ্দিনের কাছেও মির্জাপুর থানায় অভিযোগ করেছেন।

জনকণ্ঠ, ২৬ ডিসেম্বর, ২০০৮

No comments:

Post a Comment