নির্বাচনোত্তর সন্ত্রাসের আশঙ্কা ভোলার সংখ্যালঘুদের

অরুণ কর্মকার ও নেয়ামতউল্যাহ, ভোলা থেকে
ভোলায় নির্বাচনকেন্দ্রিক সন্ত্রাসের আশঙ্কায় উৎকন্ঠিত সাধারণ মানুষ। ভোলা-২ (বোরহানউদ্দিন-দৌলতখান) ও ভোলা-৩ (লালমোহন-তজুমদ্দিন) আসনে এ আশঙ্কা ও উৎকন্ঠা প্রবল। কারণ, বিগত তিনটি সাধারণ নির্বাচনের আগে-পরে ভোলার বিভিন্ন অঞ্চলে সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর ভোলা-২ ও ৩ আসনে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এ বছরও সংখ্যালঘুরা নির্বাচনের পর হামলা ও নির্যাতনের আশঙ্কা করছে। তবে এবার স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি নিয়ে সতর্ক।

জানা গেছে, বোরহানউদ্দিনের পক্ষিয়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের আনা মিয়া ও মোসলেহউদ্দিন গত ১২ ডিসেম্বর মহাজোটের প্রার্থী তোফায়েল আহমেদের জনসভা ও মিছিলে যোগ দেওয়ায় সন্ত্রাসীরা রাতে হামলা চালিয়ে মোসলেহউদ্দিনের স্ত্রী কোহিনুর বেগম ও মেয়ে নুরুনাহারকে কুপিয়ে জখম করে। এই পরিবারটি বিগত নির্বাচনে নৌকা মার্কার বিপক্ষে ছিল। এ হামলার ঘটনায় এলাকার সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্ন।

লালমোহনের লর্ড হার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে ঘুরেও মানুষের মধ্যে উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা লক্ষ করা গেছে। অন্নদা প্রসাদ গ্রামের যুবরাজ দাস বলেন, ‘সেসব হামলা-নির্যাতনের কথা মনে হলেই ভয় লাগে। আবার তো নির্বাচন এসেছে। জানি না, এবার কী আছে কপালে।’ একই গ্রামের মিনতি বালা বলেন, ‘সব সময়ই ভয়ে থাকি। অনেক মানুষ গ্রাম ছেড়েছে। আরও অনেকে নির্বাচনের সময় থাকবে না বলে শুনছি।’

পেয়ারী মোহন গ্রামের শিশুগুপ্ত দাস বলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ইতিমধ্যে তাঁদের হুমকি-ধমকি দেওয়া শুরু হয়েছে। ফাতেমাবাদের স্নৃতি রানী বলেন, ‘আমাগো আর ভোট দেওনের ইচ্ছা নাই। কিন্তু ভোট না দিলেই যে হামলা-লুটপাট হইবে না, হের তো ঠিক নাই।’ জিএম বাজারের বাসিন্দারা জানায়, সেখানকার পুলিশক্যাম্পটির জন্য তারা অনেক স্বস্তিতে আছে। নির্বাচনের সময় এটি যেন তুলে নেওয়া না হয়।

লর্ড হার্ডিঞ্জ ইউপির ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আবুল কাশেম ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য নজির আহাম্মদ বলেন, এবারও যে আগের মতো ঘটনা ঘটবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

এলাকার বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ জানায়, লালমোহন ও তজুমদ্দিনে তিনটি সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী বাহিনী ছিল। এগুলোর নাম ছিল মৌমাছি বাহিনী, ভুট্টো বাহিনী ও বাবুল বাহিনী। এই বাহিনীর সন্ত্রাসী, তাদের পৃষ্ঠপোষক ও গডফাদারেরা এবারের নির্বাচনেও বহাল তবিয়তে আছে। সন্ত্রাসী বাহিনীর অনেক সদস্য এখন ভোলার চারপাশের নৌপথে দস্যুবৃত্তিতে নিয়োজিত আছে। ডাঙায় ফিরে আসতে তাদের কতক্ষণ?

লর্ড হার্ডিঞ্জের তপন মহাজন বলেন, ২০০১ সালের নির্বাচনের দিনও বোঝা যায়নি, রাতেই তাঁরা পৈশাচিক হামলা-নির্যাতন-লুটপাটের শিকার হবেন। এবারও যে তেমন হতে পারে না, তা বিশ্বাস করবেন কীভাবে?
নির্বাচন সামনে রেখে গত ১৪ ডিসেম্বর জেলা আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক কমিটির সভায় সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেন। এ সভায় বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার ও পুলিশের উপমহাপরিদর্শক থেকে শুরু করে ভোলার সব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সভায় নির্বাচনের আগে ও পরে হামলা-নির্যাতন-সন্ত্রাস প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।

লালমোহন উপজেলা বিএনপির সম্পাদক মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘২০০১ সালের নির্বাচনে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। এ বছর আমরা সংখ্যালঘুদের নিয়ে বারবার সভা করেছি। তাদের স্বাধীনভাবে ভোট দিতে বলেছি। কেউ তাদের নির্যাতন করলে, হুমকি দিলে আমাদের জানাতে বলেছি।’

ভোলা-২ আসনের মহাজোটের প্রার্থী ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেন, নির্বাচন কমিশন অবাধ ও নিরপেক্ষ ভোট গ্রহণে অঙ্গীকারবদ্ধ। সুষ্ঠু নির্বাচনে তাঁরা সরকারকে সহায়তা দেবেন।
ভোলার জেলা প্রশাসক মো. মেসবাহুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নির্বাচনের আগে ও পরে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখতে উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
প্রথম আলো, ১৬ ডিসেম্বর, ২০০৮

No comments:

Post a Comment