নির্বাচনপূর্ব সংখ্যালঘু নির্যাতন ফের শুরু, আতঙ্ক

[ জননীকে গণধর্ষণ, পিতার সামনে কন্যাকে ধর্ষণ চেষ্টা, উচ্ছেদের হুমকি, বাড়িতে আগুন ]

জনকণ্ঠ ডেস্ক।। ২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকারের প্রথমার্ধে বিএনপি ক্যাডারদের হাতে সবচেয়ে বেশি সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়েছিল বরিশালের গৌরনদী ও আগৈলঝাড়া উপজেলায়। সেই লোমহর্ষক দিনের কথা স্মরণ করতেই এখনও আঁতকে উঠেন এ জনপদের নির্যাতিত সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্যরা। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এখানকার সেই বিএনপির ক্যাডাররা সংখ্যালঘু পরিবারের ওপর ২০০১ সালের মতো ফের নির্যাতন শুরু করেছে। দু'দিনের ব্যবধানে এখানে এক সংখ্যালঘু পরিবারের দু'সন্তানের জননীকে পালাক্রমে গণধর্ষণ করেছে ও পিতার সামনে এক সংখ্যালঘু পরিবারের কন্যাকে ধর্ষণের চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছে প্রভাবশালী যুবদল নেতা। অপরদিকে এক সংখ্যালঘু পরিবারের ভিটেমাটি দখল করে উচ্ছেদের চেষ্টা চালাচ্ছে প্রভাবশালী বিএনপি ক্যাডাররা। নির্বাচনের পূর্বেই সন্ত্রাসীদের এহেন তৎপরতায় এ অঞ্চলের সংখ্যালঘু পরিবারের মধ্যে ফের আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।

অন্যদিকে ফরিদপুরে আসন্ন সংসদ নির্বাচনপূর্ব সহিংসতা শুরু হয়েছে। এর অংশ হিসেবে টার্গেট করে সংখ্যালঘুদের ভয়ভীতি দেখানোর উদ্দেশ্যে তাদের জানমালের ক্ষতি করা হচ্ছে। জেলার আলফাডাঙ্গায় সংখ্যালঘু ডিশ ব্যবসায়ী বলাই কুণ্ডুর বাড়িতে বৃহস্পতিবার গভীররাতে পেট্রোল ঢেলে অগ্নিসংযোগ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। বলাই কুণ্ডু অভিযোগ করেন, অজ্ঞাত ব্যক্তিরা বৃহস্পতিবার গভীররাতে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। টের পেয়ে তিনি পরিবারের সকল সদস্যকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হলেও তাঁর বাড়িতে রক্ষিত ডিশ ক্যাবলের জিনিসপত্রসহ বাড়ির সবকিছু পুড়ে যায়। আগুনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২০ লাখ টাকা। এ ব্যাপারে আলফাডাঙ্গা থানায় মামলা হয়েছে। খবর সংবাদদাতা ও নিজস্ব সংবাদদাতার।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, মামলার এজাহার ও বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গত ২ ডিসেম্বর রাতে উপজেলার টরকী বন্দরের বাৎসরিক কীর্তন শুনে বাড়ি ফেরার পথে আগৈলঝাড়ার বারপাইকা গ্রামের দিনমজুর জগদীশ বৈরাগীর স্ত্রী দু'সন্তানের জননীকে (সুনিত্রি বৈরাগী ২৫) টরকীর দক্ষিণ বাউরগাতি গ্রামের কাঞ্চন ব্যাপারী (৩৫), কটকস্থলের ফিরোজ শিকদারসহ (২৯) পাঁচজনে মুখে কাপড় বেঁধে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। এক পর্যায়ে গৃহবধুর আর্তচিৎকারে পার্শ্ববর্তী বাড়ির লোকজন এগিয়ে আসলে ধর্ষকরা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালায়। এ সময় এলাকাবাসী ধাওয়া করে কাঞ্চন ও ফিরোজ নামের দুই ধর্ষককে আটক করে পুলিশের হাতে সোপর্দ করে। এ ব্যাপারে ধর্ষিতা বাদী হয়ে গৌরনদী থানায় পাঁচজনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেন। পুলিশ ৪ ডিসেম্বর সকালে গ্রেফতারকৃত ধর্ষকদের আদালতে প্রেরণ করে ধর্ষিতাকে মেডিক্যাল পরীক্ষার জন্য বরিশাল হাসপাতালে প্রেরণ করেছে।

ঘটনার পরের দিন ৩ ডিসেম্বর রাতে গৌরনদী উপজেলা যুবদলের দফতর সম্পাদক, চাঁদশী ইউনিয়ন যুবদলের সহসভাপতি ও বরিশাল-১ (গৌরনদী-আগৈলঝাড়া) নির্বাচনী এলাকার বিএনপির মনোনীত প্রার্থী প্রকৌশলী আব্দুস সোবাহানের ঘনিষ্ঠ সহচর রফিক চোকদার সংখ্যালঘু পুলিন চন্দ্র বাড়ৈয়ের সামনে তাঁর কন্যাকে ধর্ষণের চেষ্টা চালায়। এ সময় তারা ডাকচিৎকার শুরু করলে ঐ যুবদল নেতা পুলিনের ওপর হামলা চালিয়ে নগদ অর্থ ছিনিয়ে নেয়। আগৈলঝাড়ার কোদালধোয়া টাকাবাড়ি গ্রামের পুলিন চন্দ্র বাড়ৈ জানান, ওইদিন রাত সাড়ে এগারোটার দিকে ঢাকা থেকে সড়ক পথে তিনিসহ তাঁর ১৪ বছরের কন্যা শোভা ও ৯ বছরের পুত্র প্রকাশ গৌরনদীতে পৌঁছান। রাত অধিক হওয়ায় বাড়ি ফেরার কোন যানবাহন না পেয়ে তারা পায়ে হেঁটেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। পথিমধ্যে নাটে রামেরপাড় নামক স্থানে পৌঁছালে যুবদল নেতা তাদের পথরোধ করে। সে কমাণ্ডো স্টাইলে পিতার সামনেই তার কন্যাকে ধর্ষণের চেষ্টা চালায়। এ সময় পুলিন, তাঁর কন্যা ও নয় বছরের পুত্র প্রকাশ যুবদল নেতার পায়ে জড়িয়ে কান্নাকাটি করলেও মন গলেনি ওই পাষণ্ডের। সে শোভাকে ধর্ষণের জন্য টানাহেঁচড়া শুরু করে। উপায়ান্তর না দেখে পুলিন ও তাঁর পুত্র চিৎকার শুরু করলে যুবদল নেতা তাদের ওপর হামলা চালিয়ে সঙ্গে থাকা নগদ সাড়ে এগারশ' টাকা ছিনিয়ে নেয়। সুযোগ পেয়ে নিজের ইজ্জত বাঁচাতে শোভা পার্শ্ববর্তী কবরস্থানের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। চিৎকার শুনে এলাকাবাসী এগিয়ে এলে যুবদল নেতা দ্রুত স্থান ত্যাগ করে। এলাকাবাসী বিষয়টি স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানকে জানালে তিনি অসহায় পুলিন ও তাঁর ছেলেমেয়েকে পার্শ্ববর্তী গ্রামপুলিশ সন্তোষ কুমার দাসের বাড়িতে ওই রাতের জন্য আশ্রয় দেন। ৪ ডিসেম্বর রাতে স্থানীয়ভাবে বিষয়টি ধামাচাপা দেয়া হয়। স্থানীয় চাঁদশী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তাইফুর রহমান কচি ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন।

অপরদিকে গৌরনদীর খাঞ্জাপুর ইউনিয়নের মেদাকুল গ্রামের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সনাতন সূত্রধরের বসতবাড়ির ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে অবৈধভাবে দখল নেয়ার জন্য একই এলাকার বিএনপি সমর্থক মোবারক খান, আইয়ুব আলী, সেলিমসহ একাধিক ব্যক্তি দীর্ঘদিন থেকে নানামুখী ষড়যন্ত্র করে। এ ব্যাপারে গত ১ ডিসেম্বর সনাতন সূত্রধর বাদী হয়ে বরিশাল জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করেন। বিচারক মামলাটি আমলে নিয়ে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য গৌরনদী থানার ওসিকে নির্দেশ দেন। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে মামলা করায় তারা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে মামলা তুলে নেয়ার জন্য সনাতনকে নানারকম ভয়ভীতিসহ ভিটেমাটি উচ্ছেদের হুমকি দিচ্ছে। সন্ত্রাসীদের অব্যাহত হুমকির মুখে অসহায় সনাতন সূত্রধর এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। যে কোন সময় ওই প্রভাবশালীরা তার ভিটেমাটি দখল করে নিতে পারে বলে তিনি আতঙ্কে রয়েছেন। নির্বাচনের আগেই বিএনপির ক্যাডারদের এ লোমহর্ষক কর্মকাণ্ডে এ অঞ্চলের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে ফের আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। নির্বাচনের দিন যতই এগিয়ে আসছে, তাদের মধ্যে আতঙ্ক আরও বেড়ে যাচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্যরা জানান, নির্বাচনের আগেই (এখন থেকেই) ঘরের তরুণী, যুবতী মেয়েদের দানবদের হাত থেকে রক্ষা করতে আত্মীয়তার সুবাদে দূরে নিরাপদ আশ্রয়ে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে।

জনকণ্ঠ, ৬ ডিসেম্বর, ২০০৮

No comments:

Post a Comment