নড়াইল- ১।। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন আতঙ্কে

রিফাত-বিন-ত্বহা, নড়াইল থেকে।। বিভীষিকাময় সেইসব ভয়াল দিন-রাতের কথা ভুলতে পারেনি নড়াইলের কালিয়ার নির্যাতিত-নিপীড়িত সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা। "নৌকায় ভোট" দেয়ার অপরাধে ২০০১ সালের এক অক্টোবর নির্বাচন পরবর্তী সময়ে তাদের ওপর নেমে আসে সীমাহীন অত্যাচার-নির্যাতনের খড়গ। এবারের নির্বাচনের দিন যতই এগিয়ে আসছে ততই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে প্রতিটি ঘরে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এবং আওয়ামী লীগের কাণ্ডারি হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় এক নেতা দলীয় মনোনয়ন বঞ্চিত হওয়ায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে চরম ভীতি ও আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। তারা অন্য কোন রাজনৈতিক নেতার ওপর আস্থা রাখতে পারবেন না। সব মিলিয়ে নড়াইল-১ আসনের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ১৮ ভাগ ভোটার এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা এক অজানা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারা আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়নে পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানিয়েছেন শেখ হাসিনার কাছে। পাশাপাশি এবারের নির্বাচনে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা এবং ভোটাধিকার প্রয়োগের নিশ্চয়তা দাবি করেছেন। এ খবর সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের।

জানা গেছে, অধিক সংখ্যালঘু অধ্যুষিত নড়াইল-১ নির্বাচনী আসনে মোট ভোটার ১ লাখ ৮২ হাজার ৯শ' ৭৩ জন। এর মধ্যে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ভোট রয়েছে প্রায় ১৮ ভাগ। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আস্থার ওপর ভিত্তি করে এখানে আওয়ামী লীগের দুর্গ গড়ে উঠেছে। নড়াইল সদরের ৫৬টি ইউনিয়ন ও কালিয়া উপজেলার ১৩ ইউনিয়ন ১টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত নড়াইল-১ আসন বরাবরই আওয়ামী লীগের দখলে থাকে। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে এই আসনে দলীয় কোন্দল এড়াতে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগের সভানেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই নির্বাচন করে জয়লাভ করেছিলেন। তার একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন পর পর তিনবার আওয়ামী লীগের টিকেটে নির্বাচিত মনোনয়ন বঞ্চিত সাবেক এমপি ধীরেন্দ্র নাথ সাহা। দল বদল করে ধীরেন্দ্র নাথ সাহা ধঅনের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করায় তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বীতা হয়েছিল।ওই নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে শেখ হাসিনাকে ভোট দেয়ার অপরাধে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নেমে আসে নানা অত্যাচার-নির্যাতনের খড়গ। শেখ হাসিনা এই আসনটি ছেড়ে দিলে উপনির্বাচনে চারদলীয় জোটের প্রার্থী ধীরেন্দ্র নাথ সাহা জয় লাভ করেন। ধীরেন্দ্র নাথ সাহা নির্বাচিত হবার পরপরই কালিয়াতে শুরু হয় নতুন উদ্যমে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, সমর্থক এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর ধারাবাহিক নির্যাতন। ২০০১ সালে জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরই নড়াইলের কালিয়ার সংখ্যালঘু অধ্যুষিত বিভিন্ন গ্রামের মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে জোটের ক্যাডার বাহিনী। জোটের এমপির নির্দেশে জোট ক্যাডাররা উল্লাস করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, সমর্থক এবং বেছে বেছে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে ভাংচুর, লুটপাট, হত্যা এমনকি গণধর্ষণে উন্মত্ত হয়। ধারাবাহিক অত্যাচার-নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় শত শত সংখ্যালঘু পরিবার বাড়িঘর, সহায়সম্পদ ফেলে জীবন বাঁচাতে ভারতে চলে যায়। অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে যেসব পরিবার এখনও মাটি কামড়ে পড়ে আছে তাঁরা সেইসব বিভীষিকাময় দিনরাতের কথা মনে পড়লে এখনও আঁতকে ওঠে। বর্বোরোচিত জোট ক্যাডারদের নগ্ন হামলার শিখার কৃষ্ণ ঘোষ সময়মতো চিকিৎসার অভাবে তার স্ত্রীকে বাঁচাতে পারেননি। নির্মম এই ঘটনার দিন জোট ক্যাডাররা তার বাড়িতে হামলা চালায়। এ সময় জোট ক্যাডারদের প্রতিরোধের মুখে হামলার শিকার হয়ে বাড়ির উঠানেই কৃষ্ণ ঘোষের স্ত্রী হেনা ঘোষ মারা যায়। এ ধরণের শত শত ঘটনা ঘটেছে কালিয়াতে। যার বেশিরভাগই অপ্রকাশিত রয়ে গেছে। জনকণ্ঠসহ বিভিন্ন পত্রিকায় যেসব ঘটনা ছাপা হয়েছে তা ঘটে যাওয়া ঘটনার চারভাগের এক ভাগ। কালিয়ার সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে "নির্বাচন মানেই নির্যাতন।" এবারও তারা চরম ভীতি ও শঙ্কার মধ্যে রয়েছে। যে দলই ক্ষমতায় আসুক এবারও তাদের ওপর হামলা হচ্ছে না--- এমন নিশ্চয়তা এখনও মেলেনি। এখনও ভুলতে পারেনি বিভীষিকাময় সেব দুঃসহ স্মৃতি। শত অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে মাটির টানে যেসব অসহায় হিন্দু পরিবার এখনও টিকে আসে, তারা এবারের নির্বাচনে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা এবং ভোটাধিকার প্রয়োগের নিশ্চয়তা দাবি করেছে।

কালিয়ার সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রভাবশালী নেতা কমল আখী বিশ্বাস ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, "নৌকায় ভোট" দেয়ার অপরাধে তার পরিবার ধারাবাহিক নির্যাতনের শিকার হয়। হামলা চালিয়ে তার বাড়ি ভাংচুর, লুটপাট এমনকি মিথ্যা মামলা দিয়েও হয়রানি করা হয়েছে। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, নির্বাচন মানেই যদি নির্যাতন হয়, সেই নির্বাচনের দরকার নেই। অভিযোগের সুরে কমল আখী বিশ্বাস আরও বলেন, অনেক আশা নিয়ে নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়েছিলাম, নির্বাচিত করেছিলাম সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে। তিনি (শেখ হাসিনা) এই আসনটি ছেড়ে দেয়ায় সংখ্যালঘু পরিবারগুলোর ওপর পাঁচ বছর ধরে চলে জোট ক্যাডারদের ধারাবাহিক তাণ্ডবলীলা। এ সময়ে একমাত্র কালিয়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র কবিরুল হক মুক্তি ছাড়া অন্য কোন রাজনৈতিক নেতা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পাশে দাঁড়াননি। কিন্তু আওয়ামী লগের ত্যাগী এবং জনপ্রিয় এই নেতাকে এবারের নির্বাচনে মনোনয়ন না দেয়ায় সেখানকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের মাঝে ক্ষোভ, হতাশা এবং অজানা আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এ আসনে যে প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েছে, তিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হলেও তাঁর ওপর সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আস্থা রাখতে পারছে না। নিজেদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষরা তাদের শেষ ভরসা আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী কবিরুল হক মুক্তিকেই সমর্থন দিয়েছেন। পাশাপাশি দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছে দলী মনোনয়ন পুনর্বিবেচনা করে কবিরুল হক মুক্তিকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী করার দাবি জানিয়েছেন। কালিয়া পৌরসভার সাবেক কমিশনার তাপস বিশ্বাস জনকণ্ঠকে বলেন, প্রতীক দেখে নয়, এবারের নির্বাচনে ব্যক্তিকে দেখে ভোট দেয়া হবে। কবিরুল হক মুক্তি ছাড়া একমাত্র শেখ হাসিনাকে তাঁরা মেনে নেবেন। আসন্ন নির্বাচন যদি সুষ্ঠু ও অবাধ পরিবেশে হয় তাহলে তিনি ভোট দিতে যাবেন। কিন্তু সেই নিরাপত্তার সুযোগ কতটুকু- এই প্রশ্ন এখন কালিয়ার সংখ্যালঘু ভোটারদের মুখে মুখে।

দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৯ নভেম্বর, ২০০৮

No comments:

Post a Comment