গ্রেফতার আতঙ্কে গলাচিপার হিন্দুগ্রাম পুরুষ শূন্য

গ্রেফতার আতঙ্কে গলাচিপার হিন্দুগ্রাম পুরুষ শূন্য।। দুর্গাপুজো বন্ধের উপক্রম

গলাচিপার দক্ষিণ চর মোন্তাজের হিন্দুগ্রাম গত প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। গ্রেফতারের ভয়ে পুরুষরা কেউ বাড়িঘরে ফিরতে পারছে না। পুলিশ তাদের তাড়া করে ফিরছে। এনজিওর কর্মীরা কিস্তি আদায়ের জন্য সকাল-সন্ধ্যা জোরজবরদস্তি করছে। হাঁড়ি-পাতিল ধরে টানাটানি করছে। এতে গ্রাম জুড়ে চলছে আতঙ্ক আর মাতম। নারী ও শিশুরা পড়েছে চরম বিপাকে। আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কারও ঘরেই ঠিকমতো রান্না হচ্ছে না। অনেকের দিন কাটছে না খেয়ে। দুর্গাপুজো বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। মন্দিরে পড়ে আছে অর্ধসমাপ্ত দুর্গা প্রতিমা। নেতৃস্থানীয় কয়েকজন সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে দু'টি মামলা দায়েরের কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আতঙ্কগ্রস্ত লোকজন অভিযোগ করেছে, হিন্দু গ্রামের মানুষ সোনারচরে বছরের পর বছর মাছ ধরে জীবিকানির্বাহ করে আসছে। এখন সোনারচরের মাঝের ওপর নজর পড়েছে কয়েক প্রভাবশালীর। তাদের উৎখাত করে সোনার চরের দখল নিতেই প্রভাবশালীরা মিথ্যা মামলা করে লোকজনদের গ্রামছাড়া করেছে। সরেজমিন অনুসন্ধানকালে এ সমস্ত তথ্য পাওয়া গেছে।

গলাচিপা উপজেলার সর্বশেষ দক্ষিণপ্রান্তের গ্রাম চর মোন্তাজ। এর পরেই বিস্তীর্ণ সাগর। গ্রামের পূর্বপ্রান্তে রয়েছে সংখ্যালঘু হিন্দুদের একটি বিশাল পাড়া, যা হিন্দুগ্রাম হিসেবে পরিচিত। প্রায় দেড় শ' পরিবারের বাস এ গ্রামে। লোকসংখ্যা সাত থেকে আট শ'। প্রায় সবাই নদী ভাঙ্গনের শিকার। গলাচিপাসহ দেশের নানাপ্রান্ত থেকে বিভিন্ন সময়ে এ গাঁয়ে এসে ঠাঁই নিয়েছে তারা। সোনারচরের খালগুলোতে মাছ ধরে এরা জীবিকা চালায়। বন বিভাগের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে রাজস্বের বিনিময়ে তারা বছরের পর বছর ধরে মাছ ধরছে। এ বছর হঠাৎ করেই কয়েক প্রভাবশালীর নজরে পড়ে সোনারচরের মৎস্যখনির ওপরে। সোনারচরের দখল নিতে প্রভাবশালীরা মরিয়া হয়ে ওঠে। এরই ধারাবাহিকতায় চর মোন্তাজের সবুজ খলিফা (২৫) গত ১৭ সেপ্টেম্বর পটুয়াখালী দ্রুত বিচার আদালতে গ্রামের নেতৃত্বস্থানীয় নারায়ণ হাওলাদার, বিশ্ব কবিরাজ, সুমন কবিরাজ ও নিরা হাওলাদারসহ বন বিভাগের কয়েক কর্মচারীকে জড়িয়ে চাঁদাবাজির একটি মামলা দায়ের করে। এর আগে ছাইদুল ইসলাম ১২ সংখ্যালঘুকে জড়িয়ে রাঙ্গাবলী থানায় আরেকটি মামলা দায়ের করে। এ দু'টি মামলা দায়েরের পরই গোটা হিন্দু গ্রামের দৃশ্যপট পাল্টে যায়। গ্র্রেফতারের ভয়ে গ্রামের সমস্ত পুরুষ গাঁ ছেড়ে পালিয়ে যায়।

অনুসন্ধানকালে গ্রামে কোন পুরুষ খুঁজে পাওয়া যায়নি। নারী এবং শিশুরা ঘরের আড়াল থেকে বাইরে আসতে চাইছে না। বয়সের ভারে অনেকটা নুইয়ে পড়া কুসুম রানী (৭০) ঘরের দাওয়ায় বসে জানান, তাঁর ছেলে মনীন্দ্র কবিরাজ সোনারচরে ঝাঁকি জাল দিয়ে মাছ ধরে ৬ জনের সংসার চালায়। কিন্তু মামলা হওয়ার পর থেকে সে পলাতক। এখন আর সংসার চলে না। গত চব্বিশ ঘন্টায় এক মুঠো চালভাজা ছাড়া আর কিছুই পেটে পড়েনি। শিপ্রা রানী (৩২) জানান, তাঁর স্বামী নারায়ণ হাওলাদার পালিয়ে থাকায় দু'টি সন্তান নিয়ে দিন কাটছে খুবই কষ্টে। কোনদিন পেটে কিছু পড়ে আবার কোনদিন না খেয়েই থাকতে হচ্ছে। শেফালী রানী (৩৫) জানান, তাঁর স্বামী সুনীল মণ্ডল মইয়া জাল দিয়ে সোনারচরে মাছ ধরত। মামলার পর থেকেই সে কোথায় গেছে তা বলতে পারছে না কেউ। দু;টি সন্তান সুজন আর সাথীকে নিয়ে তার দিন কাটছে খেয়ে না খেয়ে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল, গ্রামের লোকজন কয়েকটি এনজিওর কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বন বিভাগে রাজস্ব জমা দিয়ে সোনারচরের খালগুলোতে মাছ ধরত। মামলার পর মাছ ধরা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গাঁয়ের নারী-শিশুরা পড়েছে আরেক সঙ্কটে। সকাল-সন্ধ্যা এনজিওর কর্মীরা কিস্তির জন্য তাগাদার পর তাগাদা দিচ্ছে। কিস্তির জন্য কেউ কেউ ঘরের হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে টানাটানি করছে। তরী রানী (৩৫) জানান, তিনি একটি এনজিও থেকে ৮ হাজার টাকা ঋণ এনেছেন। তাঁর সাপ্তাহিক কিস্তি আড়াই শ' টাকা, যা তিন সপ্তাহ ধরে দিতে পারছেন না। এনজিওর কর্মীরা কিস্তির জন্য সকাল-দুপুর হানা দিচ্ছে। গালাগালি করছে। ছায়া রানী (৪০) দু'টি এনজিও থেকে ১৭ হাজার এবং এক মহাজনের কাছ থেকে সুদে এনেছেন ৭ হাজার টাকা। তিনি জানান তাঁর উপর এখন ত্রিমুখী চাপ চলছে। গ্রামের প্রতিটি পরিবারের লোকজন এখন এ ধরণের দুঃসময় পার করছে। এদিকে পুরুষদের পালিয়ে থাকা এবং মাছ ধরা বন্ধ হয়ে যাওযায় গ্রামের একমাত্র দুর্গাপুজোটিও বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। রাধা রানী মণ্ডল, সবিতা রানী হাওলাদার, শেফালী রানীসহ কয়েকজন জানান, গ্রামের একমাত্র মন্দিরটিতে তারা নিজেরা চাঁদা তুলে কয়েক বছর ধরেই নিয়মিত দুর্গাপুজো করে আসছেন। এবারেও পুজোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কারিগর প্রতিমা তৈরি করা শুরু করেছিল। কিন্তু এখন পুজো উদযাপন করতে পারবেন বলে তাঁরা মনে করছেন না। যে কারণে প্রতিমা তৈরির কারিগরকে বিদায় করে দিয়েছেন। বর্তমানে মন্দিরে পড়ে আছে অর্ধসমাপ্ত দুর্গা প্রতিমার মূর্তি। গ্রামের লোকজন অভিযোগ করেছেন, একটি মামলার বাদী সবুজ খলিফা প্রায়ই তাদের গ্রামে ঢুকে হুমকি দিচ্ছে। শুধু সোনারচর নয়, তাদের গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বলছে। তবে সবুজ খলিফা হুমকির অভিযোগ অস্বীকার করে মামলার কারণ সম্পর্কে সাংবাদিকদের জানান, সোনারচরে মাছ ধরা বন্ধ হলেই সে মামলা তুলে নেবে।

সবুজ খলিফার দায়ের করা মামলাটি যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তার প্রমাণ মেলে মৎস্যজীবী মোশারেফ দালালের অভিযোগে। তার অভিযোগ, তিনি সোনারচরের বাইরে সাগরে জাল দিয়ে ইলিশ মাছ ধরেন। সাগরের এ অংশটি দখল করার জন্যই সবুজ খলিফা তাকে এ মিথ্যা মামলার আসামী করেছে। এ মামলার নেপথ্যে বন বিভাগের স্থানীয় রেঞ্জ অফিসারের মদদ রয়েছে বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। রেঞ্জ অফিসার মোঃ তৌহিদুল ইসলাম এ অভিযোগ অস্বীকার করে জানিয়েছেন, মূলত সোনারচরে দু'টি গ্রাপের সৃষ্টি হয়েছে। দু'টি গ্রুপই প্রভাবশালী। মাঝখানে সংখ্যালঘু হিন্দুদের বলির পাঁঠা বানানো হয়েছে। যা খুবই দুঃখজনক। তিনি আরও জানান, গরিবও নিরীহ হিন্দুরা যাতে সোনারচরের খালগুলোতে আবার মাছ ধরতে পারে তিনি এ জন্য উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে সুপারিশ করেছেন। উর্ধতন কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন।
দুর্গাপুজো বন্ধ হওয়ার উপক্রম প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী অফিসার একেএম মহিউদ্দিন সাংবাদিকদের জানান, বিষয়টি তার জানা নেই। তবে যদি সত্যিই তা হয়ে থাকে, তিনি পুজো উদযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন।

দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০০৮

No comments:

Post a Comment