১১ সংখ্যালঘুকে পুড়িয়ে মারার নেপথ্য পিশাচ চুনোপুটি থেকে কোটিপতি সন্ত্রাসী আমিন চেয়ারম্যান

১১ সংখ্যালঘুকে পুড়িয়ে মারার নেপথ্য পিশাচ চুনোপুটি থেকে কোটিপতি সন্ত্রাসী আমিন চেয়ারম্যান


বাঁশখালী (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি : বাঁশখালীর সন্ত্রাসী গডফাদার, জোট আমলের মহাক্ষমতাবান আমিনুর রহমান ওরফে সৌদি আমিন একসময়ে ছিলেন ছা-পোষা কেরানি। ভাগ্যান্বেষনে একপর্যায়ে চলে যান সৌদিআরব। ফিরে এসে কাঁচা পয়সার জোরে বনে যান ইউপি চেয়ারম্যান। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে চাচাত ভাই সাবেক বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী জাফর"ল ইসলাম চৌধুরীর আর্শিবাদে উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদন মনোনীত হন। জোট শাসনের পাঁচ বছরে তিনি চুনোপুটি থেকে পরিণত হন কোটিপতিতে। বাঁশখালীতে এমন কোনো অপকর্ম ছিল না যা তার ইশারায় হতো না। পুলিশের সাথে ছিল তার সারাক্ষণ উঠাবসা। ফলে শত অপকর্ম করলেও পার পেতে কষ্ট হতো না তার।

এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, আমিন চেয়ারম্যান এককালে বাঁশখালী কলেজে অফিস সহকারির চাকরি করতেন। অনিয়মের কারণে বরখাস্ত হন। অতঃপর ভাগ্য ফেরাতে বসেন বিয়ের পিঁড়িতে। শ্বশুর বাড়ী থেকে যৌতুক হিসাবে ভিসা নিয়ে চলে যান সৌদিআরব । ১৯৯৬ সালে চাচাত ভাই জাফরুল ইসলাম চৌধুরী বিএনপি থেকে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পরে আমিন চেয়ারম্যান ভাগ্যের চাকা আরেকদফা ঘোরাতে দেশে ফেরেন। জাফরুলের ক্যাডার হিসেবে যুক্ত হন বিএনপির সঙ্গে। ২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকার গঠন করলে জাফরুল ইসলাম চৌধুরী প্রতিমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তার আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে আমিন চেয়ারম্যান বনে যান বাঁশখালীর অপরাধ জগতের ডন। ইউপি নির্বাচনে ছলে বলে কৌশলে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। জোট সরকারের আমলে পুরো বাঁশখালী ছিল তার নিয়ন্ত্রনে। বাঁশখালীর প্রশাসন চলত তার কথায় ।

এলাকবাসী জানেন, ২০০৩ সালে ১৮ই নভেম্বর বাঁশখালীর চাঞ্চল্যকর ১১ জন সংখ্যালঘুকে পুড়িয়ে মারার ঘটনার নেপথ্য নায়ক আমিন চেয়ারম্যান। মামলার বাদী বিমল শীল থানায় এজাহার দায়েরকালে ঘটনায় আমিন চেয়ারম্যানের জড়িত থাকার কথা বললেও প্রতিমন্ত্রীর ভাই হওয়ায় পুলিশ তার নাম এজাহারে রাখেনি বলে অভিযোগ রয়েছে। ঘটনার পরপরেই বিভিন্ন মহল থেকে তাকে গ্রেফতারের দাবী উঠলেও পুলিশ থাকে গ্রেফতার করতে সাহস পায়নি। বরং মামলার তৎকালীন তদন্ত কর্মকর্তা এএসপি (সাতকানিয়া সার্কেল) ক্লারেন্স গোমেজের সাথে আমিন চেয়ারম্যানের গভীর সম্পর্কের সখ্যতার অভিযোগ উঠে। একই গাড়িতে চড়ে তারা দুজন থানায় যেতেন। সার্কেল ক্লারেন্স গোমেজ বাদীকে না জানিয়ে অতিগোপনে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। চার্জশিটে মামলাকে স্র্রেফ ডাকাতি ঘটনা হিসাবে উল্লেখ করেন। বাদী চার্জশিটের বিরুদ্ধে নারাজি দিলে আদালত মামলাটি পুনঃ তদন্তের নির্দেশ দেন। পরে পুনঃ তদন্ত করলেও চার্জশিটে আমিন চেয়ারম্যানের নাম বাদ দেওয়া হয়। এএসপি সাতকানিয়া আগের ন্যায় অতি গোপনে এই চার্জশিট প্রদান করেন। বাদী বিমল শীল পুনরায় পিটিশন দেন। আদালত মামলাটি পুনঃতদন্তের নির্দেশ দেন। বর্তমানে মামলাটি সিআইডির তদন্তে রয়েছে।

জানাগেছে, ২০০৪ সালে বাঁশখালীর সালে বাঁশখালীর কালীপুর গুনাগরী এলাকায় আশরাফ নামের এক যুবককে আমিন চেয়ারম্যানের নির্দেশে খুন করে সন্ত্রাসীরা। মৃত আশরাফের মা হোসনে আরা তার ছেলে হত্যার ঘটনায় আমিন চেয়ারম্যান জড়িত বলে অভিযোগ করেন এবং ঐ মামলায় আমিন চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট রয়েছে। বাঁশখালীর বহুল আলোচিত গডফাদার, চাঞ্চল্যকর ১১ হত্যাসহ ৯ মামলার পলাতক আসামী, বাঁশখালী উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক, সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাফর"ল ইসলাম চৌধুরীর চাচাত ভাই কালীপুর ইউপি চেয়ারম্যান আমিনুর রহমান চৌধুরী (৫০) অবশেষে গত সোমবার বাঁশখালীর সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট জয়নাল আবেদীনের আদালতে আত্মসমর্পণ করলে বিজ্ঞ আদালত তার জামিন না-মঞ্জুর করে জেল হাজতে প্রেরণের নির্দেশ দিয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে পলাতক এই চেয়ারম্যানকে র‌্যাব, পুলিশ ও যৌথবাহিনী হন্যে হয়ে খুঁজছিল। তার আত্মসমর্পণের ঘটনায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এবং জনমনে স্বস্তি ফিরে এসেছে। এদিকে তার আত্মসমর্পণ ও তাকে নিয়ে গত কয়েকদিন ধরে দেশের জাতীয় ও স্থানীয় বিভিন্ন পত্রিকায় ফলাও করে সংবাদ প্রকাশের পর তার আরো নানা অপকর্ম এবং অজানা কাহিনী বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। চাঞ্চল্যকর ১১ হত্যা মূল অভিযুক্ত আমিন চেয়ারম্যানকে রিমান্ডে নিয়ে তার অপকর্মের রহস্য উদ্ঘাটন করতে এলাকাবাসী দাবী জানিয়েছে। সাধারণ জনগনের আশা বাঁশখালীর এই আলোচিত ব্যক্তি আমিনুর রহমানকে রিমান্ডে নিয়ে উপরোক্ত ঘটনার বিষয়ে প্রকৃত তথ্য সাধারণ জনগণ জানতে পারবে এই আশা উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে। গত ২৬ শে জুন কুখ্যাত আমিন চেয়ারম্যান নিজ বাড়ীতে বসে ছবি তুলে অথচ পুলিশ রহস্যজনক কারনে তার কোন ব্যবস্থা নেননি। জোট সরকারের ৫ বছর শাসনামলে বিশাল বিত্তবৈভবের মালিক বনে যান আমিন চেয়ারম্যান। তার নামে, বোনের নামে ও স্ত্রীর নামে বনভূমি সহ রয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ যার মধ্যে আলিশান বাড়ী, কয়েকটি মার্কেটের মালিকও তিনি। এত সম্পদ থাকার পরেও তদন্ত না হওয়ায় এ ব্যাপারে দুদকের হস্তক্ষেপ কামনা করে বাঁশখালীর সর্বত্র জনগণ।

গডফাদার আমিনুর রহমান ১৯৯৬ সালে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে চাচাতো ভাই তৎকালীন চট্টগ্রাম চেম্বার অব কর্মাসের সভাপতি সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাফরুল ইসলাম চৌধুরীর হাত ধরে বিএনপির রাজনীতিতে অংশ নিয়ে আস্তে আস্তে তিনি প্রভাবশালী হয়ে উঠেন। হয়ে উঠেন গডফাদার এবং হিংস্র। ২০০১ সালের নির্বাচনের পূর্বে চার দলীয় জোট গঠন ও বিএনপির উপজেলা কমিটিতে আমিনুর রহমান মূল ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে আর্বিভূত হন। ২০০১ সালের নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে চার দলীয় জোট ক্ষমতায় এলে চাচাতো ভাই জাফরুল কে প্রতিমন্ত্রী করা হয়। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কালীপুর ইউপির চেয়ারম্যান প্রার্থী হয় আমিন। কারচুপি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে চেয়ারম্যান পদ ভাগিয়ে নেন তিনি। এরপর থেকে ক্ষমতার দাপটে আমিনকে আর পিছনে ফিরে থাকাতে হয়নি। তিনি হয়ে উঠেন চরম বেপরোয়া। দল ও চাচাতো ভাইয়ের নাম ভাঙ্গিয়ে এই গডফাদার বাঁশখালীর অপরাধ জগতের মুকুটহীন সম্রাট এবং মূল ব্যক্তি হয়ে উঠেন। ২ পুত্র ও ১ কন্যা সন্তানের জনক বহুল আলোচিত এই চেয়ারম্যান এখন বাঁশখালীবাসীর জন্য একটি আতঙ্কের নাম। দল ক্ষমতায় থাকাবস্থায় ২০০৩ সালে বাঁশখালীর সাধনপুরে ১১ জন হিন্দু সংখ্যালঘুকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। তার নেতৃত্বে এই সন্ত্রাসী কর্মকান্ড সংগঠিত হয়েছে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। এই ঘটনা দেশে-বিদেশে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। এই চাঞ্চল্যকর ঘটনার পর পরই আমিনুর পত্র-পত্রিকার সংবাদ শিরোনাম এবং বেশ আলোচিত হয়ে উঠেন। বাদী এবং এলাকাবাসী আমিনের নেতৃত্বে এই নারকীয় হত্যাকান্ডটি ঘটানোর অভিযোগ করলেও চাচাতো ভাই মন্ত্রী হওয়ার সুবাদে মামলার এজাহারে তার নাম দিতে দেয়া হয়নি। এমনকি তাকে বাদ দিয়েই তদন্তকারী কর্মকর্তা ঘটনাটি স্রেফ ডাকাতি হিসেবে চার্জশীট দাখিল করেন। ২০০৪ সালের ১ অক্টোবর গুনাগরী এলাকার হোসনে আরার ছেলে আশরাফ আলী নামে এক যুবককে হত্যা করে ফেলে রাখা হয় পার্শ্ববর্তী একটি পানের ক্ষেতে। পরদিন সকাল সাড়ে ১০টায় লাশ উদ্ধার করা হয়। এই হত্যাকান্ডটি আমিনের ক্যাডাররা সংঘটিত করে বলে হোসনে আরার অভিযোগ। এতেও বেশ আলোচিত হন তিনি। এই মামলায় মোট ৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে গত বছরের নভেম্বর মাসে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ। এদের মধ্যে কসাই মনির ও আবদুল জলিল নামে দুই ঘাতক ইতিপূর্বে গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে কারাগারে রয়েছে। নুরুইয়া নামে অপর এক আসামী এখনো পলাতক। বাকী ৪ আসামী রয়েছে জামিনে। সর্বশেষ আমিন চেয়ারম্যানও গত সোমবার এই মামলায় কারান্তরীণ হলেন। সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ও খুন, চাঁদাবাজীসহ আমিনের নামে থানা ও আদালতে ডজনখানেক মামলা এবং অসংখ্য অভিযোগ দায়ের হলেও ক্ষমতার দাপটে তাকে পুলিশ গ্রেফতার করেনি। খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, ডাকাতি ইত্যাদি অপরাধে প্রায় ডজনখানেক মামলা কাঁধে নিয়েও এই আমিন চেয়ারম্যানই ছিলেন বিগত জোট সরকারের আমলে বাঁশখালীর ‘মিনি মন্ত্রী’। শুধুই দলীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে বর্তমানে আমিনুর আলিশান ৩ তালা বাড়ী ও কয়েকটি মার্কেটের মালিক। তার মত আলিশান বাড়ী সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাফরুলেরও নেই বলে জানা গেছে। তাছাড়া আমিনুরের রয়েছে নামে-বেনামে সরকারী বন বিভাগের পাহাড় ও বন ভূমি সহ কোটি টাকার সম্পদ। এদিকে বাঁশখালী থেকে নির্বাচিত সাবেক বন ও পরিবেশ প্রতিমন্ত্রী জাফরুল ইসলাম চৌধুরীর চাচাতো ভাই হওয়ার সুবাদে আমিন চেগয়ারম্যান নিজেই ছিলেন বাঁশখালীর অঘোষিত এমপি। তাকে চাঁদা না দিয়ে বৈধ-অবৈধ কোন ব্যবসাই করতে পারেনি সাধারণ লোকজন। সাবেক প্রতিমন্ত্রী প্রকাশ্যে ও পরোক্ষভাবে তাকে ইন্ধন যুগিয়েছেন সব সময়। সর্বশেষ ১ কোটি টাকার বিনিময়ে আশরাফ আলী হত্যা মামলাটি তুলে নেওয়ার জন্য হোসনে আরাকে নিজেই ফোন করেছিলেন জাফরুল হসলাম চৌধুরী। হোসনে আরার ভাষ্যমতে, ‘মন্ত্রী জাফরুল ক্ষমতা ছেড়েছেন ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর। পরের মাসের ২৫ তারিখ রাত ১২টা ১০ মিনিটে তিনি আমাকে ১ কোটি টাকা নিয়ে মামলাটি তুলে নিতে বলেন। আমি যখন তাকে বললাম, মামলা তুলে নেবো, তবে আপনাকে বাঁশখালীর প্রতিটি এলাকায় মাইক দিয়ে ঘোষণা দিতে হবে যে অপরাধ কার। আমার, আমার ছেলের না আপনার এবং আপনার ভাইয়ের। এ কথা শোনার পর সাথে সাথে সাবেক প্রতিমন্ত্রী ফোনের লাইন কেটে দেন। সেই থেকে আর কখনো ফোন করেননি’। দেশে জরুরী অবস্থা জারী ও ব্যাপকভাবে ধরপাকড় শুরু হলে আমিন আত্মগোপনে চলে যায়। র‌্যাব, পুলিশ ও যৌথবাহিনী তাকে ধরতে অসংখ্যবার অভিযান পরিচালনা এবং হন্য হয়ে খুঁজে বেড়ালেও তার কেশাগ্রও ছুতে পারেনি।

সূত্র: দৈনিক ভোরের কাগজ

No comments:

Post a Comment